Saturday, 30 May 2020

শুঁয়োপোকা

বালিকা

 

দেখেছেন এই বালিকাকে ? কমলিকা । কমলিকা প্রামাণিক । দশম শ্রেণী । পিতা: অবনী প্রামাণিক । সাল: ২০২০ খ্রিস্টাব্দ । সময়: বেলা দ্বিপ্রহর । সময় বয়ে যায় ।  দিন চলে যায় । কমলিকা বিকেল নিয়ে বসে আছে কাঁচা মাটির বারান্দায় । এই গ্রামে, বেশীর ভাগই মাটির ঘর । তাকে ব্যস্ত করে রাখে বিকেলের নিভে আসা, একলা যাপন, বিদ্যালয়, সিলেবাস, পাটিগণিত, জীবনবিজ্ঞান, বাংলার জীবনানন্দের শটিবনের ছায়া । তার বিকেল মানে কৈশোর ছাপিয়ে একান্ত মুকুরের হাতছানি । তার শরীর আর কল্পনার এক উজ্জ্বল মিশ্র-কলার বিস্ময় । ঘরের কানাচ ভরে তার আমড়া গাছ, কাঁঠাল গাছ, কাঁটা-ঝাড়, আস্টেল আর গুল্মের বাগান । ফুলবাগানের পাশ দিয়ে কাঁচা পায়ে হাটা রাস্তা চলে যায় প্রপিতামহের কোদালে কাটা পারিবারিক পুকুরের ঘাটে । আম জাম সজিনার বনস্পতির সবুজ প্রান্তে তার যেন একান্ত অবসর । এই হলো সৌন্দর্য । সে লক্ষ্য করছে অনেকক্ষণ ধরে, একটি সবুজ গুল্মের ডালে কোমর বেঁকিয়ে হেঁটে যায় একটি শুঁয়াপোকা 

 

কমলিকা বিস্মিত চোখে দেখছেন, শুঁয়োপোকাটা পায়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে শাখা প্রশাখায় । ওর গায়ে সবুজ পাতার ছায়া । ছায়াও যেন কিছুটা সবুজ ।  সে হেঁটে যাচ্ছে আগামী মুহূর্তগুলির পরিসীমায়, আর একটি মুহূর্ত বুঝি যে কোন সময় এই 'ড্রিম মোমেন্ট' , 'আহা' শব্দে উপনীত হতে পারে । মোহময় পৃথিবীতে আগামী জীবনের এই সমস্ত অভিজ্ঞান কোন শুঁয়ো, কোন পিঁপড়ে জানে নি বোধহয় । মানুষও বোধহয় না ।কাল কি হবে মানুষ তা জানে না । আর বিশ্বভরা প্রাণের মধ্যে মানব-প্রজাতিই এক মাত্র যখন বাড়তি । মানুষ তার আগামীর তাড়নায় পিষে যাচ্ছে নিজে । নিজের ভারে, নিজেই ন্যুজ । মেধার বাণিজ্যে পসার হচ্ছে স্বয়ং মানুষ ।  মানুষ দ্রব্য । মানুষ শিল্প ।  শিল্প পণ্য । শিল্পবুমে ফেটে পড়েছে অন্তর্জালিকা। সোশাল মিডিয়ায় শিল্পকর্মের জোয়ার । অধিক থেকে অধিকতর হোমো সেপিয়েন্স গান গাইছে, নাটক করছে, সিনেমা করছে, ছবি আঁকছে এবং অবশ্যই কবিতা লিখছে । বলা যায়, শিল্পমাধ্যমের ভিতর কবিতা লেখা একটা অধ্যায় যা অন্যতর মাত্রায় পৌঁছে গেছে । তাতে ভারতবর্ষ কেন পিছিয়ে থাকবে ? আর বাংলা ? বাংলা ও বাঙালির কাব্য প্রিয়তা নিশ্চয়ই অজানা নয় । বাংলা ভাষায় কবিতার মান কি, বাংলা কবিতার স্থান ও আগামীর সম্ভাব্য নিয়ে আমাদের উৎসুকতা বাড়ছে । এমতাবস্থায়, এমন কি কি প্যারামিটার বাংলা কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে ? কতগুলি উপাদান, শুধু বাংলা ও বাঙালি আর কতগুলি ফ্যাক্টর বহিরাগত ।  সাধারণ জ্ঞানে এইটুকু বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের কবিতাকে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য অনেক কিছুই তার নিয়ন্ত্রণ করে । এই ফেসবুক, যা কিনা বাঙ্গালির নিজস্ব নয়, অথচ তা নির্ধারণ করছে কার জনপ্রিয় হবে আর কার কবিতা বিক্রি হবে । বাজার যদিও বাংলার, কিন্তু ফ্যাক্টরটি বহিরাগত ।  বরং বলা যায় কি বিক্রি হবে আর কি বিক্রি হবে তার কতটুকু বাঙ্গালির হাতে ? বাঙ্গালির (কবিতা) পাঠ , কাব্য প্রিয়তা, পদ্য অন্তরঙ্গতা, গদ্য প্রস্তুতি সাহিত্য-বাস্তুতন্ত্রের কোন পর্যায়ে তা ভাষা নিজে নিয়ন্ত্রণ করছে না । বাঙ্গালির কবিতা লেখার প্রয়াস, শব্দবন্ধ, শব্দচাষ, গীতিময়তা, আধুনিকতা, সাহিত্য ভাষা, কবিতা, গদ্য কোন রূপে কোন পথে অদূর আগামীতে চালিত হবে তার কোন রূপরেখা আমাদের সত্যই জানা নেই । কিন্তু কিছুটা আন্দাজ করা যায় ।


প্রজাপতি


কমলিকা দেখছেন নজর করে , একটি ডাল থেকে অন্য একটি ডালে হেঁটে এসে শুঁয়োপোকাটি এসে কোমর উঁচুকরে এসে দাড়ালো লাফও দিতে পারে । কিংবা সে লাফ দেবে না ।  কিংবা হতে পারে শুঁয়োপোকাটি প্রস্তুতি নিচ্ছে আগামী জীবনের ঘনঘটার । সন্ধ্যা আর বিকালের পরিবর্তনচক্রে যে কোন মুহূর্তে সে হয়ে যেতে পারে পূর্ণবয়স্ক পিউপা, যে কোন মুহূর্তেই সে আলস্য ভেঙে খসিয়ে দেবে খোলস ।  ট্রিগার করবে করবে একটি অভিনব শিল্প ভাবনা    আহা । হলুদ, সবুজ, রংবেরঙ্গী  রূপনিয়ে সে এক প্রজাপতি হয়ে বিকেলের হাল্কা হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে পারে পাখনা ? অবাক চোখে তাকে দেখে যে কেউ বলতে পারে “ওয়াও   এইসব কথা আমাদের এই সীমিত পরিসরে জানা নেই , তবে আন্দাজ করা যায় । 

 

আসলে যে কোন পোকা , তা শুঁয়ো হোক বা কাঁচ, তার একটা জীবনচক্র আছে । তার আগামী কি, তারক্ষন বা জীবন বৃত্তের ভিতর যে টুকু অবসর সেইটুকুন আমার দেখেছি, আর যেহেতু তাকে বেশ কয়েকবার আমরা প্রজাপতি হয়ে যেতে দেখেছি, সুতরাং বলা যায় কিছু কিছু শুঁয়ো পোকা আগামীতে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাবে । পিরিয়ড ।

 

এই বক্তব্যে তেমন কিছু যুক্তি তর্ক প্রমান হলো না । এই সব তো জানা কথা । অবশ্যই সব আমাদের জানা । যেমন জানি সূর্য পুব দিকে ওঠে- পশ্চিমে অস্ত যায় । যেমন জানি, জন্মালে একদিন মরতে হবে । যেমন জানি কমলিকা দশম শ্রেণী পাশ করে, উচ্চ মাধ্যমিক দেবে । পূর্ণ যৌবনা হয়ে সে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় যাবে । আমাদের ওই টুকুনই জানা, যা আমরা দেখেছি, বা শুনেছি । এই টুকুই আমাদের জানাঅজানার বৃত্ত । এ হেন উপপাদ্যে বাংলা সাহিত্যের, বাংলা কবিতার, সর্বোপরি বাংলা ভাষার ঐটুকুই আমরা জানি, যা আমরা ছুঁয়ে দেখেছি,  ক্লাসে পড়েছি । সাহিত্য আড্ডায় অবগত হয়েছি অথবা কোন কবিতা উতসবে শহস্র কবিদের গলায় গমগম মাইকের আওয়াজে ‘কবিতা’ শুনেছি সুতরাং এই যুক্তিতে আন্দাজ করাই যায়, যে কোন কবি তাই যে কোন সময় প্রজাপতি হয়ে উড়াল দিতে পারে । আবার নাও পারে ।


বোধ


সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে সংজ্ঞা । এই সব শোনা-দেখা-বোঝা একটা লাইফ-সাইকেল বা জীবনচক্রের মতো । অর্থাৎ একটা সময়ের ব্যবধানের যার পরিসর পালটে যায় । এই ব্যাপারটি কোন দশক, বা শতক দিয়ে অনেকবার ব্যাখ্যা করে হয়েছে, কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা সীমানা বা লাইন এসে নিজেই নিজেকে ভেঙে দিয়েছে । যে কোন সংজ্ঞা , সেই সংজ্ঞাকে ভেঙে বার বার এই বলতে চায় - কোন জানাই যে তার শেষ জানা নয়, কোন জ্ঞানই তার অভিজ্ঞান নয়, সুতরাং কাল , মহাকাল, অতিমহাকাল...এই সমস্ত ব্যক্তিগত, আপেক্ষিক । শব্দ কম পড়ে যায় । তাহলে কি কবি সাইফুল ইসলাম বা কবি রণেন চ্যাটার্জি যে ফেসবুকে প্রতিদিন গোলাপ সহকারে একটা একটা করে কবিতা ছাপছেন, আর তাতে শত শত লাইক পড়ছে, সেই কবিতাগুলো কি কোনদিন কাল, বা মহাকাল কুড়িয়ে নেবে না?

 

অন্তত আমাদের অগ্রজ কবিরা সেই রকম বলে গেছেন, আজকের গুরুদেব কবিরাও সেই কথা বলছেন, গুরুদেব সাহিত্যকাররাও সেই কথা বলছেন । আমরা বুঝতে পারছি ব্যাপারটা সেই রকম, অর্থাৎ আমাদের একটা গ্রুমিং হচ্ছে, আমরা ধীরে ধীরে কোন একটা বলয়ে শিক্ষিত হচ্ছি । আমাদের একটা অরিয়েন্টেশন হচ্ছে । যে ভাবে কাঁচা লোহাকে এশিয়া মাইনরের সে রাখাল একটি চুম্বকে পরিণত করেছিলো ।

এভাবেও বলা যায়, যে কথা আমি বা আমরা জানতাম না, কোন গুরুদেব কবি এসে এক দশকের কথা বললেন, সেই দশকের কবিতা, গদ্য, উপন্যাস সম্পর্কে জানালেন। আর যেহেতু উনি গুরুদেব, সেই কথা আমাদের না মানলেই নয় । এই সমস্ত ঘটে একটা কগনিটিভ ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে । আমাদের জান্তে বা অজান্তেই হয় । যেভাবে একটি শিশু, হিট অ্যান্ড ট্রায়ালের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে ।  এই ভাবে আমাদের বোধ জন্ম নেয় । পৃথিবী বোধ, পড়শি বোধ, নর-নারী বোধ, ভালোবাসা , ঘৃণা , ভয় বোধ । কবির মাথার ভিতরও এইভাবে কবিতা বোধ জন্মায় । কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে ।


আন্তর্সজ্জা


 

তা যখন আন্তর্সজ্জা বা অরিয়েন্টেশন নিয়ে কথা হচ্ছিলো , বোধ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে কি ? অর্থাৎ প্রশ্ন আসে, সেই বোধ কি এক রৈখিক ? প্রিয় পাঠক এতক্ষণ এই সব প্রশ্ন, ভূমিকাকে পার করে আপনি নিশ্চয় এর একটি লজিক্যাল উত্তর চাইছেন ? আর যদি উপমা যদি চুম্বক হয় , তবে নিশ্চয়ই উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বা দিক থাকবে । এইটা হলো আমাদের অরিয়েন্টেশন । অথবা দিক-মার্গ । আমরা অরিয়েন্টেশনকেও একটা বদ্ধ ধারণার ভিতর আটকে ফেললাম ।

এইবার দেখা যাক: দিক শুধু দক্ষিণ বা উত্তর কেন হতে যাবে । দিক তো আরও আছে । পুব পশ্চিম ঈশান, নৈর্ঋত ... সংজ্ঞা অনুযায়ী তবে দিক হয় 'দশ' । অর্থাৎ দশটি অরিয়েন্টেশন হবে ।নট ব্যাড । খানিক টা এগোনো গেলো । দুই দিক থেকে দশ দিকে পৌঁছানো গেলো । কিন্তু কিছুটা তথ্য ভুল ও হয়ে গেলো ।  চুম্বক কোন দিন দশ দিকে ওরিয়েন্টেশন হয় না । আর যদি হয়, সেটা হয় ইউনিডাইরেকশন ।

এই ভাবে আমি,  যে কোন শুঁয়োপোকার পরিণত রূপ একটি প্রজাপতি হিসাবে ধরতে পারি না । আপনিও হয়তো ধরবেন না । কিন্তু...  কিন্তু তাই বলে, তাই বলে তরুণ কবি সুজয়বরণ ঘোষ বা ডাকসাইটে মিস অনামিকা চ্যাটার্জী যে প্রতিদিন সেলফি সাজিয়ে সাজিয়ে ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করেন, সে কি কবিতা লেখা বন্ধ করে দেবেন ? নাকি কবিকুল ফেসবুকে কবিতা লিখে কোন দিন মহাকালে স্থান পাবেন না ?

 

কবিতা বা টেক্সট লেখার অরিয়েন্টেশন রয়েছে । কিংবা থাকাটা তেমন অস্বাভাবিক না । টেক্সট একটি অভিধান ভিত্তিক শব্দাবলীর নেটওয়ার্ক । সেইখানে আমাদের দিক নির্ণয় ক্ষমতা প্রত্যেক টেক্সটকে একটি প্যাটার্ন দেয় । সেই টেক্সটি একটি মাত্র শব্দ হতে পারে অথবা অনেকগুলি শব্দের সমষ্টি । কিছু শব্দদিয়ে বাক্য গঠন করা যায়, কিছু দিয়ে ব্যাকরণ মতে বাক্য গঠন করা যায় না । অর্থাৎ সংজ্ঞাকে সংজ্ঞা অতিক্রম করে যায় । শব্দগোষ্ঠির নিজেরই একটা বৃত্ত আছে । জীবন চক্র । যেটা শিশু বা কবি বা ঔপন্যাসিক শেখেন, শিখতেই থাকেন । তার অরিয়েন্টেশন বাড়তে থাকে । তাতে দিক শুধু উত্তর দক্ষিণ বা দশদিকে আবদ্ধ থাকেনা । কোন বাক্যের যে কোন পদ থেকে অরিয়েন্টেশন বিচ্ছুরণ হতে থাকে ।  আর আমাদের ধারনা দিয়ে সেইটা পরিমাপ করার চেষ্টা করি, বলা যায় আমাদের পরিচিত প্যারামিটার দিয়ে তা মাপার চেষ্টা করি । দূরত্বকে কে সেন্টিমিটার, তাপমাত্রাকে ফারেনহাইট, আর প্রখ্যাত কবিকে আমরা মাপি সে কতগুলো পুরস্কার পেয়েছে । এই সব পরিমাপ আমাদের জানা । যেভাবে আমরা আন্দাজ করলাম যে মিস কমলিকার দেখা শুরুয়াতের শুঁয়োপোকাটি একটি প্রজাপতিতে পরিণত হবে । নট ব্যাড । এগেইন । এতটা বোধ আর দিগদর্শন নিয়ে নানান ফ্যাঁকড়া শোনার পরেও আমরা কিন্তু এই টেক্সটটা পড়েই চলেছি অথচ আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে এক কদমও নড়িনি ।

 

তাহলে, কি এখনই বলে দিতে হবে শুঁয়োপোকাটির কি হবে ? তার কি দুটো মোলায়েম হালকা পাতার হলুদ ডানা হবে ? তাতে চিহ্ন থাকবে ওঁ ? কচি সবুজের উপর দিয়ে সে উড়াল দেবে অন্য কোন বাগিচায় ?  কথা হলো এই যে, এইটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা , নিজস্ব অভিমত , মৌলিক ভাবনা পরিসর ।  আমার মতে, আমাদের প্রত্যেকটি শুঁয়োপোকার জীবনচক্রের ডায়েরী রাখা অসম্ভব । কিংবা সে খবর রেখেই বা কি হবে । আর যদিবা প্রত্যেক শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হলো, বা নাই হলো , তার উত্তরসূরি শুঁয়োপোকার  জীবনচক্রে কাল, মহাকাল, অতিমহাকাল কি করছেন বা করবেন - তার হিসাব আমরা কি করে রাখবো ? হুম । শুধু অসম্ভবই না, মহাঅসম্ভব, অতিমহাঅসম্ভব ।  অন্তত মানব সমাজে এইরকম কবি, সম্পাদক, লেখক, গল্পকার, নাট্যকার, অথবা কোন করণিক জন্মান নি যিনি এই কাজটি করে যেতে পারেন । এই কাজটি করতে  যে যত্ন, যে যোগাযোগ, যে নেটওয়ার্ক অবশ্য জরুরী তা বাংলা ভাষার বর্তমান পরিসরে অনুপস্থিত । এটা হলো আমাদের জানা কথা । এইযে বালিকা কমলিকা  প্রামাণিক – বিকেল থেকে ফুলের বাগানে গুনগুন গুঞ্জন করছেন, তাকে এখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণযৌবনা বানাবেন না, তাকে বধুরূপে, কুচশোভিত পুস্তকহস্তে সরস্বতী রূপে কল্পনা নাই বা করলেন । সে আপন তন-মনে বিকশিত হতে চায় ।  সে চায় তার নিজের প্রেমের অরিয়েন্টেশন । নিজের ধ্বনিপল্লবের দিগদর্শন।  আর এইটাও হলো অজানা ।  যে প্রস্ফুটন, যে নাজুক সুগন্ধি ফুল তার মানব মনে লুকিয়ে আছে তাকে মুকুলেই উৎপাটিত কোর না  । 

 

 

কমলিকা ভাবেন, এইসব ফুলবাগানের কথা । গুল্মের আবছায়া , মাটির সোঁদা-গন্ধ ছোঁয়া তার গায়ে জড়িয়ে থাকে । সে দেখেন, এই বারান্দা থেকে গ্রামের আড়পার দেখা যায় । ঐ গ্রামটির নাম মধুপুর । আর ঐ আকাশের নাম নীল । গোধূলি পার হয়ে যায় তার দৃষ্টি । কতটা দূর হবে মধুপুর কদমখালি থেকে । গ্রামে কোন মাইলস্টোন নেই । তার ইতিহাস আছে । তাই ভূগোল ও আছে । দিল্লি থেকে লাহোর কতটা দূরত্ব ? চেন্নাই থেকে সিডনি ? গুগল করলে দেখা যায় ৯১২০ কিলো মিটার । উইকিপিডিয়াও তাই বলে । মাপিপিডিয়াও । আমিও তাই বলি। আপনিও তাই বলেন । এটাই সত্য । এইবার, আমি মানে, আমি পীযূষকান্তি বিশ্বাস, যে মাঝে মাঝে খেয়লাখুশী হলে কবিতা লিখি, আর আপনি মানে যে আমাকে কবি হিসাবে মানেন না - অথচ এই যে এই লেখাটা পড়ছেন । এসবই ঘটছে ২০২০ সালে । মানে সত্য ঘটনা । এইবার যদি ঘড়িটা ২০০০০০০০ বছর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, কিংবা ২০০০০০০০ বছর পিছিয়ে নেওয়া যায় - কল্পনা করুন দিল্লি যদিও দিল্লি ততদিন থাকে, সিডনি ততদিন যদি সিডনি থাকে, এবং ধরলাম গুগল ততদিন থাকে, আপনিও বেঁচে থাকলেন, আমিও বেঁচে থাকলেন । এতকিছু ধরে নেওয়ার পরেও ... মহাজাগতিক ভূগোল বলছেন, অস্ট্রেলিয়া আগে ভারতেরই অঙ্গরাজ্য ছিলো । কোন এক সময় তা মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা হয়ে গেছে । অর্থাৎ চেন্নাই আর সিডনির দূরত্ব ছিলো শূন্য । তুমি কি শুধু মিথ, শুধু পটে লেখা ? হুম । ঐ যে কথাটা যা সত্য বলে ধরেছিলাম, তাহা মহাসময়ের তারতম্যে মিথ্যা । কিংবা জাস্ট মিথ । কিংবা সত্যমিথ্যা কিছুই ঠাহর হয় না ।  

ভূলোক


 

এখানে এইটি টাইমলাইন দেওয়া যাক, যদি সত্যিই কোন টাইমম্যাসিন থাকতো । মানব সভ্যতার ইতিহাস, ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো কথার সুযোগ থাকতো না । সাহিত্য কি হবে, সাহিত্য কি হবে না, মানুষ পড়বে , মানুষ পড়বে না , অনেক কথার উত্তর পাওয়া যেতো। এমনও তো হতে পারে, মানুষ আগে মানুষ ছিলো না, কিংবা মানুষ পরে মানুষ থাকবে না । কবি কবি থাকবে না, সম্পাদক সম্পাদক থাকবে না । হতেই পারে। একটা সত্য, অসত্য, অর্ধসত্য, কাল্পনিক সত্যের একটা প্লট করে টাইমলাইনে ফেলা যাক ।    

 

একটা তারিখ যদি আমরা নির্ধারণ করি । এই ধরুন আজ । খ্রিস্টাব্দ হিসাবে ধরলে ২০২০ । মানে ০ খ্রিস্টাব্দকে বেসলাইন ধরলে, আমরা ২০২০ আর্থ-ইয়ার পার করে এলাম । এখন সাহিত্যের আধুনিক যুগ, অনেকে আধুনিকোত্তর যুগ, বা উত্তর আধুনিক যুগ বলে থাকেন । অন্যান্য ভাষাকে আলোচনার বাইরে রাখলে যা দাঁড়াচ্ছে, বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগ শুরু হচ্ছে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে । তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া । “বাংলা সাহিত্য কালবিচারে বাংলা সাহিত্যকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০), মধ্যযুগ (১২০০-১৮০০) ও আধুনিক যুগ (১৮০০-)। মধ্যযুগ আবার তিনভাগে বিভক্ত: আদি-মধ্যযুগ (১২০০-১৩৫০), মধ্য-মধ্যযুগ (১৩৫০-১৭০০) ও অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৭০০-১৮০০)। অনুরূপভাবে আধুনিক যুগও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত: প্রস্ততিপর্ব (১৮০০-১৮৬০), বিকাশের যুগ (১৮৬০-১৯০০), রবীন্দ্র-পর্ব (১৯০০-১৯৩০), রবীন্দ্রোত্তর পর্ব (১৯৩০-১৯৪৭) এবং বাংলাদেশ পর্ব (১৯৪৭-)।” 

এমত অবস্থায় যুগের ভিতর যদি ব্যবধান আমরা দেখি, ৭-৮ শতাব্দীতেই  যুগ পালটে যাচ্ছে । মানে, আমরা আধুনিক যুগ, অন্য মতে উত্তর আধুনিক-যুগে আছি বা এই মাত্র পার করেছি । ব্যাকরণে যেহেতু আধুনিক থেকে আরও আধুনিক শব্দ নেই, তাই আন্দাজ করা যায় এই যুগ স্কিম করাটা একটা টেম্পোরারি এরেঞ্জমেন্ট, সাময়িক ধারণা মাত্র । আধুনিক যুগ যদি ১৮০১ সালে শুরু হয়, আন্দাজ অনুযায়ী ২৫০০ সাল নাগাদ সেই যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা । তখন, ব্যাকরণ কে ভেঙে ফেলবে ব্যাকরণ । তিন ডিগ্রির সুপারলেটিভকে রিপ্লেসে করবে মাল্টিডিগ্রির ডাইনামিকস । সেই স্টেজ পার করলেই নব্য নব্য প্রেফিক্স/সাফিক্স উপলব্ধ হবে । এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, এই রচনার পরিসরের বাইরে ।


অণুগল্প


 

এই যে মাথায় ছাতা তুলে তেঁতুল গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, কমলিকা দেখেন ওই গ্রামের দূরগামী পথের পাশে একাকী ঠাই দাঁড়িয়ে । তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কতবছর এভাবে দাঁড়িয়ে আছো? কমলিকা দেখেন, তেঁতুল গাছটিকে, জন্ম থেকেই একা ।  গ্রামের পথে, যেখান দিয়ে হেঁটে যায় গ্রামের কৃষক, গাড়োয়ালের গরু, গাড়ি । পুকুরের পাশদিয়ে রাস্তাটি চলে যায় । ধানক্ষেত দুপাশে দুলে ওঠে মনোরম মলয় অভিলাষে । তার পিতা অবনী প্রামাণিক একজন কৃষক । কন্যার জন্য পিতার হৃদয়ে অগাধ স্নেহ । একদিন রাত্রে খুব ঝড় বৃষ্টি । গ্রামে এমনিতেও বিজলি নাই । অন্ধকার রাত্রি । কেউ যেন মনে হলো দুয়ারে কড়া নাড়ে । একি, এতো মনোহর প্রামাণিক । কমলিকার ছোট কাকা । দুই বাড়ি পরেই থাকেন । চেহারা দেখে মনে হয়, চিন্তিত । কি ব্যাপার ? কি হলো ? মনোহর বললেন, গোয়ালে ধবলীকে দেখা যাচ্ছে না । ধবলী, মানে দুধ-ধবধবে গাভী । কোথায় গেলো ? বিদ্যুৎ চমকায়, আঙ্গিনা চমকে যায়, রান্না ঘর, শোবার ঘর, গোয়াল দেখা যায় । ধবলী নাই । মনোহর বিপত্নীক । একা থাকেন। স্ত্রী  সম্প্রতি গত হয়েছেন । ধবলীকে নিয়ে তার দিন কাটে । গোয়ালে ধবলীও একা । একটা বাছুর হয়েছিলো, মারা গেছে । মনোহরের সর্বক্ষণের সাহারা হলো ধবলী । ব্যথার মাঝে যা কিছু সাদা ধবধবে দেখেন , মনোহর তাকেই ধবলী বলে ঠাউরে নেন ।

‘মনোহর – যা, ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড় ।  সকালে উঠে দেখিস, ধবলী গোয়ালেই আছে’ । কমলিকার পিতা বলেন । মনোহরের মন মানে না । তার বুকে ব্যথা চিন চিন করে ওঠে । সে পুকুরের পাশ দিয়ে অন্ধকারে বৃষ্টি মাথায় বাড়ি ফেরে। সহসা, আবার বিদ্যুৎ চমকায়, সে দেখে তেঁতুল গাছটার নিচে ধবলী বৃষ্টি পড়া আকাশের দিকে গায়ে গা মিশিয়ে আধেক লীন হৃদয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে ।


অভিমুখ


গল্পটি, একা একটি তেঁতুল গাছের । যার রাত কাটে না । সে সঙ্গী খোঁজেন । মনোহর, সেও একা । কিন্তু সে মানুষ । তাকে বুঝতে দিতে নেই যে সে একা । ধবলী কি তা বোঝে ? সে কি তবে একা নয় ?

এবার এই গল্পটি, হাইপোথিসিসের আকারে রি-রাইট করা যাক । মনোহর ও তেঁতুল গাছটি বাদ দিলে , গল্পটি গল্প থাকে না । কিছু শব্দ যদিও পড়ে থাকে । কমলিকা, অবনী দুজনই হিউম্যান ক্যারেক্টার । ধরা যাক, অনেক রাতে আবার দুয়ারে কড়া নাড়া হলো । এইবার অরিয়েন্টেশন দেখা যাক । কিভাবে কি কি বাক্য, পদ, বিরাম, কী কী বিচ্ছুরণ করে । শ্রোডিঞ্জারের বিড়াল ওত পেতে থাকে । যে কোন জীবন মৃত্যুর মাঝখানে – ভাবনা, অভাবনার মাঝখানে পাঁচটি পদ কারক বিভক্তিতে একজন বিড়াল হয়ে ওঠে । প্রত্যেকটি পার্ট অব স্পীচ নেটওয়ার্কের একটি নোড বা ব্যস্ত পাঁচ মাথার মোড় । মোড় থেকে যে কোনদিকেই যাওয়া যায় । গল্পটি থেকে যদি তিনটে শব্দ বেঁছে নেওয়া যায় । “অবনী”, “বাড়ি”, “আছো” । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটার কথা মনে পড়ে কিনা ? আরও কিছু শব্দ, ধ্বনি, অনুষঙ্গ নিয়ে দেখা যাক কি দাঁড়ায় । “দুয়ার” শব্দটি নিয়ে একটি অনুষঙ্গ ক্রিয়াপদ “এঁটে” শব্দটি যদি যোগ করি, “ঘুমিয়ে”, “পাড়া” শব্দ-বন্ধ নিয়ে এমন একটা লাইন লেখা যেতেই পারে । “দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া” । রাতে মনোহর যখন হন্তদন্ত হয়ে এলেন, দুয়ারে কড়া নাড়লেন, সেই ভাবে আর একটি বাক্য বিচ্ছুরণ হতেই পারে “কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া” । আরে বাহ । এতো দেখি, ব্যক্তিগত বোধকে জাগিয়ে তুলছে কিছু বাক্যবিচ্ছুরণ । মৃত্যু চিন্তা গ্রাস করে রাখে সমস্ত জীবন কে, সেখানে কবিও জীবন্ত মানুষ । একজন ওরিয়েন্টেড বোধপ্রাপ্ত মানুষ । তার মৃত্যু চিন্তায় কেবলই মনে হয় কেউ যেন ওপার থেকে ডাকছে, আয়, আয় । চিতা কাঠ ডাকছে । আয় চলে আয় । কবিও নিজেও যেতে চান, কিন্তু এখুনি নয় । তার সংসার, ঘর, বাড়ি, পুত্র কন্যা তাকে বেঁধে রাখে, কবি তার সন্তানের মুখ ধরে একটা চুমু খেতে চান । সেই তো ভয়, অবনীর সেই ভয় । ভয়কে জাগিয়ে তোলে অনুষঙ্গ, অনুষঙ্গ ট্রিগার হয় । প্রত্যেক পার্ট অব স্পিচেই তা হতে পারে । পুনঃ-লিখিত হাইপোথিসিসটা কেমন হলো তাহলে দেখা যাক:      

 

“অবনী, বাড়ি আছো?” দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া /কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া / ‘অবনী, বাড়ি আছো?’ / বৃষ্টি পড়ে এখানে বারো মাস / এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে / পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস / দুয়ার চেপে ধরে / ‘অবনী, বাড়ি আছো?’ / আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী / ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি / সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া / ‘অবনী, বাড়ি আছো?’ 


বাইনারি


 

কি সত্য তাহলে ? কি হলো কবিতা ? আর বাংলা কবিতায় সত্যের কি অবস্থান ? নাকি অন্য ভাষার কবিতার থেকে বাংলা কবিতা কিছু আলাদা ? সত্য , মিথ্যা আর তার মধ্যমাবস্থা নিয়ে শ্রোডিঞ্জারের যে বিড়ালটি শুয়ে আছে, সে মৃত বা জীবিত নিয়ে অনেক আলোচনা হলো, অথচ এখন পাঠক জানতে চায় সত্য কি ? কিংবা মিথ্যা কি । যে কোন একটা পেলেই অন্যটা গণনা করে জানা যাবে । সত্যকে তাই ১ ধরি, আর মিথ্যাকে ০ । থাকাকে সত্য, না থাকা কে যদি মিথ্যা ধরা যায়, সত্য মিথ্যা, শূন্য আর এক মিলে একটা প্যাটার্ন গড়ে ওঠে । প্যাটার্ন রিপিট হলেই মানব মনের কাছে তা চেনা পরিচিতের মতো লাগে । আমাদের রক্তের ভিতরে যা ক্লান্তি কর, আমাদের বোধের এই আন্তর্সজ্জাকে আমরা বলে উঠি - কবিতা । কবিতা বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় ক্রিয়া দিয়ে গঠিত । বাক্য ব্যাকরণ ভাবে সম্পূর্ণ না হলেও বোধের আন্তর্সজ্জায় শব্দাবলী যদি প্যাটার্ন হয়ে দাঁড়ায়, সেই ভাষার সেইটাই একটি বাক্য, কবিতার সেটাই একটা পঙক্তি । কোটি কোটি আকাশ ভরা সূর্যতারার যে কোন বিন্যাস তাই কবিতা হতে পারে । কালপুরুষ ও একটি কবিতা ।


ক্রমসজ্জা


 

সমস্ত কবিতাই লেখা যায় না , সমস্ত বাক্য স্তবক হয় না । স্তবকের জন্য সমস্ত লেখা, শব্দ, বাক্য মিলে আমাদের ইতিহাসের পাতায় ফেলে দেখতে হয় । অন্তত: এই ২০২০ তে বসে যদি দেখি, আমাদের মানব সভ্যতার ও সাহিত্যের একটা ইতিহাস তো আছেই । এবং নিশ্চিত একটা ভবিষ্যৎ ও আছে । আর একটা সময় রেখা যখন আমরা এঁকে ফেলেছি, একটা রেখাকে কেন্দ্র করে তার বাম পাশে ও ডান পাশে কিছু থাকবেই । অর্থাৎ, জিরো জিরো থেকে, আমরা যদি গণনা করি- ১,২,৩,৪,৫...অবধারিত ভাবে সেটা এক সময় ৯,১০,১১,১২ র দিকে যাবে । সুতরাং এটা বলা যায়, একটা ইতিহাস থাকলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কিছুটা আন্দাজ করা যায় । যে ভাবে ১০ ১১ কে সংজ্ঞা প্রদান করে ১ ও ২ ও দশমিক ক্রমাংক – এই ভাবেই বাক্য, শব্দ, পঙক্তি গড়ে তোলে কবিতার অবয়ব ।

এই বার আর একটি সিরিজ দেখি, ১,৩,৫,৭,?  অথবা ক, খ, চ, ছ, ট, ঠ, ত, ? ।

জিজ্ঞাসা চিহ্নে একটি সংখ্যা বা অক্ষর বসবে । এই সিরিজে পরিষ্কার ভাবে, একটা সংখ্যা মিসিং আছে । উত্তর হিসাবে বলা যায়: জিজ্ঞাসা চিহ্নে যথাক্রমে ‘৮’ ও ‘থ’ বসবে । 

পরের সিরিজটাতে একটা বর্গকে স্কিপ করা হলো । তবুকি আন্দাজ করা কঠিন ? এগুলো আন্তর্সজ্জাকে অবয়ব দিচ্ছে । অর্থাৎ আমাদের  শিক্ষাকে একটা রূপ দিচ্ছে । যে রূপটা আদতে ছিলো না । যে প্যাটার্ন কোনদিন লিখে ফেলা হয় নাই । অথচ তা আমাদের জানা শব্দ বা জানা অক্ষর দিয়েই তা সাজানো । অথচ আমরা বলছি যে জিনিস আমরা দেখি নাই, শুনি নাই, পড়ি নাই, তা আছে । তার অবয়ব ধরা দরকার, তাকে লিখে ফেলা দরকার ।

এই বার আর একটা সিরিজ নেওয়া যাক, ১,৪,৯,১৬,২৫,? ক, খা, গি, ঘী , চু, ছূ , জে ? । উত্তর দিন। জিজ্ঞাসা চিহ্নে কি হবে ?

উত্তর: যথাক্রমে ৩৬ ও ঝৈ । সংখ্যাকে বর্গ করে সিরিজটা গঠন করা হয়েছে । আর অক্ষর বিন্যাসে ব্যঞ্জন বর্ণের বর্গের অক্ষরকে বাড়তে দেওয়া হয়েছে যেখানে স্বর মাত্রাকে একক ভাবে বাড়ানো হয়েছে ।

 

এই বার আর একটা সিরিজ নেওয়া যাক, ১,৫,২,১০,৩,১৫,৪,২০,৫, ? কাল, খাল, গাল, ঘাল, চাল, ছাল, জাল, ?।  উত্তর দিন। জিজ্ঞাসা চিহ্নে কি হবে ?

উত্তর: যথাক্রমে ২৫ ও ঝাল । অল্টারনেট সংখ্যাকে এরিথমেটিক প্রোগ্রেশনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে । ১,২,৩ বাড়ছে । ৫,১০,১৫ বাড়ছে । তারা অল্টারনেটিভ । এবং শব্দক্রমে ‘ল’ অক্ষরটি বারবার আসছে । এবং সিরিজটি ‘বর্গে’ থাকা অক্ষরগুলি নিয়ে ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে ।

এই বার আর একটা সিরিজ নেওয়া যাক, ৫, ৭৫, ২৫, ৯৫, ২২৫, ৪৪৫, ১৫ ? কাক, শালিক, টিয়া, ময়না, বক, ?।  উত্তর দিন। জিজ্ঞাসা চিহ্নে কি হবে ?

উত্তর: যথাক্রমে ৩৫ ও চড়ুই । এই উত্তরে এই বার একটু হিউম্যান টাচ দরকার । সমস্তটাই গণিত নয় । এইখানে শৈশব থেকে শিখে আসা নানান রান্ডম লার্নিং ও কগনিটিভ প্রয়োগ করা হয়েছে । সিরিজটি ক্রমানুসারে নয় । এইখানে আমরা ‘ক্রম’ অরিয়েন্টেশনের সংজ্ঞা অতিক্রম করলাম । দেখতে পাচ্ছি, প্রত্যেকটি নাম্বারের শেষে একটি ‘৫’ আছে । সুতরাং যে কোন নাম্বার যার পিছনে ‘৫’ আছে , সেইটাই হতে পারে উত্তর । ৩৫ প্রথম এমন সংখ্যা যা আমার মনে এলো । সেই ভাবে, শব্দগুলি যদি দেখি- এগুলি এক একটি পাখির নাম । সুতরাং যে পাখিটির নাম প্রথম আমার মনে এসেছে, সেটাই উত্তর । যদি কেউ উত্তর দেন ৪৫ ও চিল । উত্তর বেঠিক হয় না । একটি প্রশ্নের একাধিক উত্তর থাকতে পারে । এবং সেই উত্তর দেবার দায় কোন কবিই নিচ্ছেন না । বরং এমন একটি ধারনা রয়েছে, কবিতা ব্যাখ্যা করাই যাবে না, কবির নিজের কবিতার অর্থ বুঝিয়ে দেবার দায় নেই ।

আর একটা সিরিজ নিচ্ছি । ০, ১১৯১, ১৫২৬, ১৫৫৬, ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১ । নাম্বারগুলি শুধু নাম্বার নয় , সঙ্গে ইতিহাস মেলান । শিক্ষা মেলান । হিউম্যান টাচ । স্বাধীনতার একটা স্বাদ পাবেন, আমি এখানে ব্যাখ্যা দিচ্ছি না ।

এই তো আন্দাজ করা যাচ্ছে...বরং আন্দাজ একটা বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে । আর প্রত্যেকটি বিশ্বাস করুন একটা কবিতার একক । কবিতার প্রত্যেক পঙক্তি, শব্দ একটি সিরিজের একক । যা আমাদের জানা অথবা জানা নেই । তবে আন্দাজ করা যায় । প্রত্যেক জানার মাঝখানে অস্থায়ী অজানা র‍্যান্ডম । কোন সিরিজ পরিণত, কোনটা পরিণত নয় । পরিণত সিরিজের র‍্যান্ডোমাইজেশন থেকে এটা শিক্ষা নেওয়া যায় যে, সিরিজ যে কোন শব্দ থেকেই হতে পারে । আগামীতে সিরিজ নিয়ে একটি পূর্ণ রচনা লেখা যেতে পারে ।

পংক্তিময় বাক্য ছন্দোবদ্ধ হয়, গল্প কাহিনী পয়ার বদ্ধ হয় । বোধশক্তি বলে, এই তো একে চন্দ্র, এই তো দুয়ে পক্ষ , তিনে নেত্র...কখন জানি শৈশব পার হয়ে কমলিকা কিশোরী হয়েছে, তার বৃন্তে ফুটেছে দুটি কুসুম । কবিতার জীবন চক্রে তা প্রাচীন সন্ধ্যাভাষা, ছন্দময় পয়ার, গীতিকবিতা পার করে তা একদিন অজান্তেই শাশ্বত ক্লাসিক যুগসন্ধি পার হয়ে বিষয় বিবেচনায় আধুনিক হয়ে উঠেছে । বিজ্ঞরা তাদেরকে পার করে উত্তরআধুনিক কবিতাও বলে থাকেন । যুগ পালটে যাচ্ছে, মানুষের ভাষা, চরিত্র, টেকনোলোজি, ঘর, মনস্তত্ব পালটে যাচ্ছে । আধুনিক থেকে অধিকআধুনিক হয়ে মানুষ এখন টেক্সট বেসড ভাষা থেকে নন-টেক্সট ভাষায় কথা বলছে । তার পরেও নিজেদের প্যাটার্ন খুঁজে পাচ্ছে । এ এক অত্যাধুনিক ভাবনা পরিসর । লিখিত, অলিখিত যা কিছু লেখা হচ্ছে, তা অত্যাধুনিক ।         


অত্যাধুনিক কবিতা


 

অত্যাধুনিক কবিতা বলে কিছু হয় না । আপাতত হয় না, দুনিয়ার সব কায়দা কেতায়, নোটবুকে কেউ অন্তত লিখে যায়নি । কি তার সংজ্ঞা? আর যেখানে সংজ্ঞাকে আগেই নালিফাই করা হয়েছে, সেইমতো কোন সময়রেখা দিয়ে অত্যাধুনিক কবিতাকে ট্যাগ করা যায় না । ভেঙে গড়া যায়, কেউ কেউ করতে চাইছে । কিন্তু গঠন, বুনন, নির্মাণ, বিনির্মাণ সেই ত্রিমূর্তির আদলে । সেখানেও আন্তর্সজ্জা বা অরিয়েন্টেশন কাজ করছে । ঠিক মতো ভাঙা হচ্ছে না । ঠিক মতো গড়া হচ্ছে না । তাহলে কি ফেসবুক মিথ্যা, বাংলা পিডিয়া মিথ্যা, বাংলা ব্লগ ম্যাগাজিন মিথ্যা ? এরা মহাকালের ঠিক কোন যুগের ? প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক...এই যুগ সংজ্ঞা সংখ্যায় কম পড়ে যায় । ব্যাকরণ শুধু ডিগ্রিকে কে তিনটে ভাগে ভাগ করেছে (পজিটিভ, কম্প্যারাটিভ ও সুপারলেটিভ) । অথচ আমার দরকার চার ভাগ, পাঁচভাগ, অনন্ত ভাগ । ইউনিডাইরেকশন । মাল্টিডাইমেনশোনাল অখন্ডমন্ডলম আকারং ব্যাপ্তম যেন চরাচরাম । যা থাকে জনক বিষ্ণুর নাভিপদ্মে শিশু ব্রহ্মার ধুলো খেলা, তার বেড়ে ওঠা, এক পা দুপা করে চলতে শেখা...অ আ ক খ শেখা । বোধ থেকে বোধে উপনীত হওয়া, কবিতা থেকে উড়াল দিয়ে কবিতায় যাপন করা । আর মহাকালের অমোঘ নিয়মে আর মহাদেবের প্রলয় নৃত্যে তার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া । 


কগনিটিভ


 

কমলিকা, ভাবেন জীবনানন্দের রূপসী বাংলার কথা । অ, আ, ক, খ, ১, ২ । কমলিকা, ভাবছেন – এই নদীটির নাম ধানসিঁড়ি কেন ? প্রতিবাদী গাছটির নাম অশ্বত্থ কেন ? দোয়েল , ফিঙে , শালিকের ভিতর কোনটা গান গায়, কোনটি উড়ে পালায় । সে বুঝতে পারছে, ১ এর পরে ২ আসে, ৫ আসে না । সে বুঝতে পারে, বিকেল হলে রোদ নরম হয়ে আসে । আগামী সন্ধ্যার ঘণ্টাধ্বনি সে যেন শুনতে পায় । আচ্ছা, এই যে পুকুর পারের রাস্তা , এটা কোথায় যায় ? তার কি কোন গন্তব্য আছে ? কমলিকার ভুল হয়ে যায়, এই গাভীটি কোন ভাবেই ধবলী নয় । সব সাদা গাই, ধবলী হতে পারে না । অর্থাৎ, কমলিকা একটা দুটো যুক্তি তর্ক করা শিখছে । সেই শৈশব থেকেই সে শিখছে, ভুল হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে । আবার শিখছে । কোনবার সে নিজেই বুঝতে পারে কোনটা ঠিক । কোনবার বাড়ির বড়দের কেউ ভুলটা ধরিয়ে দেয় । ক্রমাগত, ভুল, ঠিক, ভুল , ঠিক, আন্দাজ, শিক্ষা, প্রশ্ন, শিক্ষক, বাবা, মা, গ্রামের রাস্তা তাকে ঘিরে এক নেটওয়ার্ক তৈরি করে । সেই নেটওয়ার্কে সে কোন বার সুখানুভূতি পায়, কোন বার বিরক্তি । তার নিজের বোধের একটি পরিধি সে নিজেই রচনা করা । শৈশব পার হতে হতে সে বুঝতে পারে, তার পরিধি বেড়ে এদিক ওদিক উঁকি মারে, নিজেই বিস্মিত হয়ে নিজের প্রশ্নের বাহবা দিতে থাকেন । আয়না । আয়না বড় প্রিয় এই সময়ের । আয়নাতে নিজেকে দেখে কমলিকা আত্মহারা হয়ে যান । এই হলো বিউটি, অপার পৃথিবীর এক আশ্চর্য বিস্ময় । ওয়াও ।


স্মৃতিসারনী


স্মৃতিসারনী বা মেমরীস্ট্রিম বলে কিছু আমাদের জানা নেই । এনিয়ে কোন কিতাবেও কোন কথা লেখা হয় নাই । কিন্তু মনে করুন, সেই রকম কিছু আছে, যে পথ দিয়ে আপনি একটা কথা ভাবতে ভাবতে গেলেন । ফিরে আসার সময় সেই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন । এবং অন্য কথায় উপনীত হলেন, সেই শব্দ, সময়, আলো, বাতাস, মানবিক সমস্ত ভাবনাগুলি অন্য যে পথে যেতে পারতো, তার একটা নেটওয়ার্ক বা জাল বুনে ফেললেন । অর্থাৎ, অনুষঙ্গকে যদি লিখে ফেলা যায় এবং তার ক্রমানুসারেও লিখে ফেলা যায়, এবং তা যদি রিপ্লে করা যায় ?

কতটা মনে রাখা যায়, কতটা দূর , সেই হলো মানব মনের কাছে একটা সীমাবদ্ধতা । একটা এক রৈখিক পথ ধর যদি আমরা যদি সরাসরি যাই, একজন গড়পড়তা মানুষ, পর পর সাতটি সংখ্যা মনে রাখতে পারে । যদি, ব্যতিক্রমকে ছেড়ে দিয়ে এটাই বেঞ্চ-মার্ক ধরি, একটি শব্দকে, তার পরের শব্দকে লাইনে রেখে,  একনজর দেখে সাতটি শব্দকে মনে রাখা সম্ভব । সেই শব্দাবলীর আনুষঙ্গিক রূপ, রস গন্ধ ব্যতিরেকে । যদি রূপরসগন্ধকে গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখতে হয়, সেইগুলি একজন এভারেজ মানুষ সাতটি শব্দের পর গুলিয়ে ফেলবে । অর্থাৎ যদি মুখস্থ না করা হয়, সে ভুলে যাবে । এইখানে অরিয়েন্টেশন বা অন্তর্সজ্জা পদ্ধতি কাজে আসে । যদি শব্দাবলীর সঙ্গে কিছু আনুষঙ্গিক কাহিনী যোগ করি, অরিয়েন্টেশন হতে থাকে । একটা কাঁচা লোহা কে ক্রমাগত চুম্বক দিয়ে ঘসতে ঘসতে, লোহাটি যে ভাবে চুম্বক হয়ে যায় ।

এই ভাবে কতটা মনে রাখা সম্ভব । আর তা ছাড়া, উপপাদ্যের প্রথমেই আমরা ধরে নিয়েছে, মূল সমস্যাটি একরৈখিক । সুতরাং, বহুরৈখিক বা ইউনিডাইরেকশনের কথা তো এখানে উত্থাপন করাই যাচ্ছে না । একরৈখিক নিয়েই যদি আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি, মানবমনের এইরকম সীমানা কে পরিবর্ধন করার কথা একটু বলা যায় কি ?


অবতার


 

সিনেমাটাকে মনে আছে ? প্যান্ডোরা নামের গ্রহে, মানব প্রজাতির কলোনি । সেখানে থাকেন নাভিস প্রজাতি যা এখনো তীর-ধনুক সভ্যতার যুগে রয়েছে আর মানব প্রজাতি হাসিল করে নিয়েছে উন্নত মানের আগ্নেয়াস্ত্রের, অত্যাধুনিক বোমা, ও হাই-ফাই যুদ্ধবিমান । তারা কলোনাইজ করতে চায়, সেই গ্রহটিকে। আর গ্রহের বাসিন্দারা একটি বিশালায়তন বৃক্ষের নীচে বাস করেন, আর সেই বৃক্ষের নিচে রাখা আছে একটি মহামূল্যবান  পাথর যা মানব প্রজাতি হাসিল করতে চায় ।

গল্পটি হাইফাই মানব প্রজাতির আর অর্বাচীন প্রজাতির লড়াই নিয়ে । কিন্তু আমি আজ অন্য কারণে তার উল্লেখ করলাম । উক্ত বৃক্ষটির একটা বৈশিষ্ট্য হলো, সে আপনার মনের কথা আপলোড করে সংরক্ষণ করে রাখতে পারে । আপনি কি ভাবেন, কি কথা বলেন, কাকে ভালোবাসেন, কবিতা বলতে কি মনে করেন সমস্ত অব্যক্ত কথাই আপনি স্টোর করে রাখতে পারেন । এমনকি , আপনার মৃত্যুর পরেও সেই কথাগুলো শেষ হয়ে যায় না । আপনার উত্তরপ্রজন্ম সেই কথাগুলি ডাউনলোড করে শুনতে পারে । স্মৃতিসারণির ঊর্ধ্বগমন (আপলোড) ও নিম্নগমণ (ডাউনলোড) একটি ঝর্ণাধারার মতো । একটু একটু করে বাইট বাই বাইট তা প্রতিলিপি হতে থাকে । এমন কোন কবিতা ব্যাংক আছে যেখানে আমি আমার সমস্ত কবিতা গচ্ছিত রেখে যাবো ? কি  এমন কোন বৃক্ষ সত্যই থাকতে পারে,  গল্পের গরু কি সত্যিই গাছে উঠতে পারে ?


ম্যাসিন লার্নিং


 

যখন কবিতা নিয়ে এতো কথা, তার নৈসর্গিক আপিল, তার গীতিময়তা, তার আবেগ, উপমা, রূপ রস গন্ধ । অক্ষরে অক্ষরে এইযে প্রেম আর রক্তক্ষরণের ইতিবৃত্ত এই ঐশ্বরিক অনুভূতির সমতুল্য । এই যে “সতত হে নদ মোর পড় মনে”, “আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী” “হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি” অথবা “যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো” ।ছাপার অক্ষরে যে স্রোতের মতো বয়ে যা আড্রিনালিন, অগ্নাশয়ে প্রজাপতি উড়ে যায় । কিন্তু এমনকি কোন পরিসর আছে যা এই সমস্ত শব্দ, পঙক্তি, প্যাটার্ন  খোঁজ, উৎপাদন, সংরক্ষণ করা যায় ?

এই ধরুন: “যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো” । যদি একটা সিরিজ হয় । “যেতে” আর “পারি” শব্দের ভিতর প্রোগ্রেশনটা কি ? একটা শব্দ থেকে অন্য শব্দটা কি ভাবে এলো । ‘যেতে’ শব্দটা আমরা প্রথম কোথায় শিখি ? আর ‘পারি’ শব্দটাই কেন পরে এলো ?  হিডেন স্টেট কি কি ? “যেতে” র পরে “চাই” শব্দটিও থাকতে পারতো । কবির মনের তখন কি অবস্থা , কি উপমা তার মনে বিরাজ করছিলো তার উপর নির্ভর করে । তবু “পারি” শব্দটা যখন এসেই গেলো । “কিন্তু” শব্দটি আসার কতটা সম্ভাবনা কতটা যদি পরিমাপ করা যেতো ? সেই ভাবে যদি “কেন” এবং “যাবো” শব্দদুটির প্রোবাবিলিটি কতো ? তাহলে, সেই অরিয়েন্টেশন, নেটওয়ার্ক, হিডেন স্টেট নামক প্যারামিটারগুলি এসে পড়ে । আর যেহেতু এই শব্দগুলি সমস্তই অভিধান থেকে নেওয়া, একজন বাংলাস্কুলে পড়া যে কোন ছাত্র এই শব্দাবলী পারস্পারিক সহাবস্থান সম্পর্কে জানেন । সুতরাং এই শব্দচয়নের রূপ রস গন্ধ বা আনুষঙ্গিক হিডেনস্টেটগুলি আইডিয়ালী লিখে ফেলা যায় । শিশু সেভাবেই শেখেন । কমলিকাও সেইভাবে শিখছেন । শুঁয়োপোকা সিরিজের পরবর্তী সংখ্যা যে প্রজাপতি সে জেনে ফেলেছে । এখন যার উড়াল দেবার পালা।  

শব্দের পর কোন শব্দ আসে, তা আমদের শৈশব থেকে শিখতে হয় । কিছুটা শুনে, কিছুটা পড়ে, কিছুটা আন্দাজ করে । প্রত্যেক শব্দের পর, আর একটি শব্দ আসে, সেখানেও অন্য শব্দের আগমন ঘটে কিংবা ঘটে না । এই ভাবে অভিধানের প্রত্যেকটি শব্দ থেকে অন্য শব্দটির একটি লিঙ্ক পথ আছে । শব্দাবলীর একটা বিশাল নেটওয়ার্ক যদি তৈরি করা যাইয় ? সেগুলিও যদি লিখে ফেলা যায় । আর তার যদি কোন অর্থ থাকে , কিংবা অর্থ করে নেওয়া যেতে পারে ? এই মহাবিশ্বে এমন কোন শব্দ, পঙক্তি বা বাক্য থাকতেই পারে যা মানব বোধের কাছাকাছি? মানুষের ইতিহাসের কাছাকাছি ? এমন কি কোন সিরিজ নাম্বার আছে যার এরিথমেটিক প্রগ্রেশন একটি মানুষের বোধগম্য প্যাটার্ন ? যদি ‘অবতারে’ উল্লেখিত সেই বৃক্ষটি  এই ‘আর্থ’এ থাকতো, আর আমরা সেই বোধগুলি ডাউনলোড করে ভ্যালিডেট করে নিতাম ।  

 

একটু উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলে প্রশ্ন করা যায়, টেক্সট ( বাক্য ) কি জেনারেট (উৎপাদন)  করা যায় ? মানে আনুষঙ্গিক শব্দাবলী ? নিদেনপক্ষে সম্ভাব্য শব্দাবলী ? যে ভাবে একটি শিশু করেন ? যে ভাবে কমলিকা ভাবেন শুঁয়োপোকাটি একটি প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হবেন কিনা ?কবিতা না হোক, মহাবিশ্বের সমস্ত শব্দাবলীকে একত্র করে কিছু অর্থসম্পন্ন বাক্য কি গঠন করা যায় ?

 

হয়তো যায় । ম্যাসিন পারে । ম্যাসিন শিখতে পারে । ম্যাসিন, মানব জীবনের বহুকর্মে ব্যবহৃত হচ্ছে। ম্যাসিন, মানুষেরই লিখিত এই আশ্চর্য কবিতা । যা নিজেই একটা বক্তব্য, কবিতা হতে গেলে শুধু অক্ষর হওয়াই জরুরী নয় । অক্ষর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এই সংজ্ঞা কিন্তু অক্ষর কে ছাড়িয়ে যাচ্ছে না ।  


ব্যাক ট্রাক


 

যতদূর স্মৃতিসারনী দিয়ে যাওয়া গেলো, কে কি ভাবে গেলো , আমাদের কোনদিন জানা হবে না । প্রত্যেক শব্দ, বাক্য, অনুষঙ্গ, রূপ রস গন্ধ যদি লিখে রাখা যেতো , অবশ্য ঐ রকম একটি পঙক্তি আমরা লিখতে পারতাম । কিছু ঘুরিয়ে, কিছু পেঁচিয়ে আমরা লিখছি যে নয়, তাও না । সোশ্যাল মিডিয়া, বইমেলাগুলি ঘুরলে তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায় । সমস্তই আন্দাজ করা, প্যাটার্ন খুঁজে নেওয়া, সুখানুভূতি জাগায় এমন প্যাটার্ন আবিষ্কার করা । এগুলি সময় সাপেক্ষ, সঙ্গ সাপেক্ষ, এবং অবশ্যই পাঠক সাপেক্ষ । রূপ রস গন্ধ প্রত্যেক দশকে পালটে যাচ্ছে । সময়, পাঠক বদলে যাচ্ছে । আর শব্দ বাক্য অনুষঙ্গ থেকে যায়, অন্তত শতাব্দী পর্যন্ত তা কনস্ট্যান্ট থাকছে । এই তো বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম অব্যয় ও ক্রিয়া । একটি অর্থবহ বাক্য থেকে একটি কবিতা পঙক্তিতে উপনীত হলে, , অনুষঙ্গ, রূপ রস গন্ধ , সময়, পাঠক, পলিটিক্স, গুরুবাজী, প্রকাশন ইত্যাদি ফিল্টারের মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে, বা হয়েছে । অর্থাৎ, আজকের যেটা কবিতার পঙক্তি, মাইক বাজিয়ে বাজিয়ে কবিতার আসরে যে কবিতা পড়া হচ্ছে – তা আসলে একটি স্মৃতিসারনী । সারণীটি সম্পূর্ণ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে । শব্দের পর শব্দ যে ভাবে আসছে, যে ভাবে অভিধান তৈরি করা হয়েছে, শব্দগুলি বিশ্লেষণ করে ব্যাক ট্রাক করা যায় । লুকিয়ে থাকা অনুষঙ্গগুলি আন্দাজ করা যায় । বার বার, লক্ষ কোটিবার সেই আন্দাজগুলি আসল পঙক্তির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় । সেই ভাবে, একশো শতাংশ না হোক, অন্তত: কিছু শতাংশ অনুধাবন করাই যায়, আন্দাজ করা যায় সিরিজের আগামী সংখ্যাটি কি । সেইভাবে খুঁজে পাওয়া যায় মিসিং লিঙ্ক । মনে না পড়া শব্দাবলী, বাক্য, খুঁজে না পাওয়া অন্ত্যমিল । গদ্য, উপন্যাস, কবিতার পঙক্তিতে এই ফিল্টারগুলো সেখানে গুপ্ত রয়েছে । যদি ফিল্টারগুলোকে ‘পরাষঙ্গ’ বা হিডেন স্টেট বলে অভিহিত করা যায়, সেটা এই রকম দাঁড়ায়:

 

শব্দাবলী + শিক্ষা + ‘পরাষঙ্গ’ =>  বাক্য

বাক্য + ব্যাকরণ + ‘পরাষঙ্গ’ => পঙক্তি

পঙক্তি + ‘পরাষঙ্গ’ + সজ্জা ( প্যাটার্ন)  => স্তবক 

স্তবক + ‘পরাষঙ্গ’ + পাঠক => কবিতা

 

‘পরাষঙ্গ’ বা হিডেন স্টেট, এক সময় এসে বোধ হয়ে সামনে দাঁড়ায়    এ সবই ঘটতে পারে, একটি সময়ে । এখন সময়কাল ২০২০ খ্রিস্টাব্দ । বলা যায় এখন ঘটছে ।  


প্রুফ অফ কনসেপ্ট

প্রুফ অফ কনসেপ্ট

 

“কম্পিউটার এইডেড পোয়েট্রি” । কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে কবিতা । (এথিক্যাল ব্যাপারটা যদি সরিয়ে রাখা যায়- সত্যি কি কবিতা মনুষ্যতর প্রজাতির লেখার অধিকার আছে ? ) ।  তাহলে কবিতাটা কি লেখা যায় ? একটা প্রকল্প হিসাবে, একটা সনেট লেখা যেতে পারে । ধরা যাক, কমলিকা আজ দ্বাদশ শ্রেণী । সনেটটি ডেডিকেট করাহবে উড-বি প্রেমিককে । কি কি শব্দ, বিষয়, অনুষঙ্গ লাগবে কমলিকার ? আয়না, চিরুনি, লিপস্টিক, মোবাইল ফোন, এস এম এস,  ইন্টারনেট, হোয়াটস অ্যাপ ? ধরা যাক গ্রামের নাম কদমখালি,  পঞ্চায়েত প্রধান অজয় প্রামাণিক, তার পুত্র সদ্য কেনা হিরো হোন্ডা বাইক উড়িয়ে দিয়ে পুকুর ধারের রাস্তা দিয়ে চলে যায় ? কি তার নাম ? বিজয় প্রামাণিক ? সে কেনই বা সে আজ কমলিকাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় ? ফেসবুকে তাকে একটা কবিতা পোস্ট করতে হবে । লেখা যাক তার জীবনের প্রথম সনেট । লেখা যাক একটি কম্পিউটার এইডেড কবিতা ।

 

জিজ্ঞাসা

দুদিকে বিকেল নিয়ে দৌড়ালো বাইক

দুই চোখে স্বপ্ন নিয়ে একক সড়ক

পুকুরে ডুবছে জলে রক্তিম সুরজ  

ফেসবুকে ,হে যুবক সহস্র লাইক !

 

বিদ্ধ চাহনির মধ্যে রয়েছে জিজ্ঞাসা

যুবক ! কি বলতে চাও এভাবে তাকিয়ে

এই রক্তে খেলছে যে দৌড়, স্বপ্ন, কথা

জেনো তার নাম দিতে পারি ভালোবাসা ।

 

এই চোখে কথা আছে কবিতা কাজল

জ্বলে পুড়ে যেতে চাই আগুন মাফিক

এঘর বারান্দা থেকে দূরে যেতে চাই

পথ ডাকে, সঙ্গী হলে ছুটে যেতে পারি

হে নবীন, চাও নাকি পড়তে সে কথা

যে কবিতা এ পর্যন্ত পড়া হয় নাই ?

 

কবিতাটি “লিপিকা” সফটওয়ারের সাহায্যে লেখা । কবিতাটা তেমন যুতসই হলো না । ভালো সনেটহলো না । তবে সনেট লেখার কিছু কিছু পদ্ধতি স্থাপন করা গেলো । শব্দচয়ন ও বাক্য গঠনের কিছু প্রচেষ্টা কম্পিউটার করলো, আট+ছয় অক্ষর বিন্যাস, এবং চোদ্দ লাইনে কবিতাটা লেখা হলো যেখানে ম্যাসিন সীমাবদ্ধ, সেখানে কিছুটা হিউম্যান টাচ দেওয়া হলো । এইভাবে কিছু আইটেরেশন যাওয়ার পরে, কবিতাটা এইরকম দাঁড়ালো । লিপিকা সফটওয়ারের একটি স্ক্রিনশট দেওয়া হলো ।


উড়াল


ডানা উড়িয়ে দিয়েছে প্রজাপতি । কাল যে শুঁয়োপোকাটা সম্ভাবনাময় ছিলো , আন্দাজ মতো যদিও তার প্রজাপতি হওয়ারই কথা । কিন্তু মানবমনের অক্ষোহিনী জিজ্ঞাসা, এটা কি কবিতা হলো, কিংবা কবিতা হলো না । আসলে কবিতাগুলো কখনোই কবিতা নয়, যদি সেখানে পাঠক না থাকে । মানুষ তার মনের অবস্থান খুঁজে নিতে চায়, তার নিজের কিছু হিডেন স্টেট আছে । সেগুলি সে নানান ফিল্টার হিসাবে ব্যাবহার করে । সে ক্রমাগত পারমুটেশন, কম্বিনেশন করে, এভারেজ করে চলতে থাকে, এবং এক একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে থাকে । এইভাবে জারি থাকে তার শিক্ষা । শিক্ষার কোন একটি স্তরে সে ক্লাসিফাই করে করে নিজেরই চেনা প্যাটার্নের সঙ্গে, কিংবা সে বুঝতে পারে এটা কোন প্যাটার্নই নয় । সেটা কবিতা হলো বা না হলো, তার দায় থাকে না । পাঠক গ্রহণ করে বা বর্জন । কমলিকা, কবিতা লেখা শিখছে । পাখনা মেলেছে সে । তার মনের সাহিত্য বৃক্ষটি এখন সবে মাত্র অঙ্কুরোদগম করলো । যা শীঘ্রই শিশু পত্রালিকার বিকশিত হবে । এই পৃথিবীর শিল্প, সংস্কৃতি, পণ্য, দাম, দর, কেনা বেচা লেগে যে একদিন মহীরুহে পরিণত হবে । যদি স্মৃতি সারণী সত্যিই সম্ভব হয়, টেকনোলোজির উৎভাবনের মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে তা সীমিত ভাবে লিখিত হবে । দু দশক আগেও সে সোসাল মিডিয়া আসে নাই, কাগজে নিজে প্রকাশ করতে হয়েছে কবিতা, গদ্য , চিঠি । আমার নিজস্ব আন্দাজ মতো এই দশকের শেষেই কম্পিউটার এইডেড কবিতা লেখা শুরু হয়ে যাবে । আগামী ১৫ বছরের মধ্যে টেক্সট উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে বাংলা ভাষায় । আজকের বাংলা সাহিত্যের  যদি এই আজকের মতো থাকে, ২০৪০ সাল নাগাদ, স্বয়ংক্রিয় ভাবে আজকের যুগের সনেট কবিতা কম্পিউটারের লেখা যাবে । কম্পিউটার এইডেড কবিতা থেকে তখন আমরা অপেক্ষা করবো কম্পিউটার জেনারেটেড কবিতা । আজকের এভারেজ ফেসবুক কবিতাগুলি আগামী ১০ বছরেই রিডান্ডান্ট হয়ে যাবে । কবি মানিক ঘোষ, কবি শ্রীলতা রায় তবুও কোন না কোন ওয়েবসাইটে কবিতা লিখতে থাকবেন, কবি নাসিফা বানো ও অণু গল্পকার বিপিন গুহরায় কাগজের গন্ধ শুঁকার নেশায় কলেজ স্ট্রীট থেকে বই প্রিণ্টেট হার্ডবোর্ডে বাঁধানো বই বের করবেন । যদি সে পর্যন্ত বেঁচে থাকি, আগামী ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে কবিতার আজকের কবিতা অবস্থার আমূল পরিবর্তন দেখে যাবো । মানব প্রজাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কবিতা লিখছেন কম্পিউটার । আজ যে কবিতায় আমরা অসাধারণ অপূর্ব বলে একে অপরকে ফেসবুকে কমপ্লিমেন্ট করছি, সেই কবিতাও ২০৫০ অব্ধি রিজেনারেট করা যাবে । এই রকম সফটওয়ার তৈরি হচ্ছে, অনেক এইরকম সফটওয়ার তৈরি হয়ে যাবে । দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছি ডিপ লার্নিং, তথাকথিত স্টোরেজ সিস্টেম কে বদলে দিচ্ছে ক্লাউড টেকনোলোজি । আর্টিফিসিইয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন সহজ লব্ধ । কম্পিউটিং পাওয়ার গুণিতক হারে বাড়ছে, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট উপলব্ধ  হয়েছে । এথিক্যাল প্রশ্ন তবুও থেকেই যাব । তখন, কি বাকি থাকে , থাকে শুধু অন্ধকার, সম্মুখ দেওয়ালে ফুটে ওঠা একক ফুলদানী । আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ আমার কবিতাখানি ।


ডিসক্লেমার


এই গদ্য উল্লেখিত সমস্ত চরিত্রগুলি কাল্পনিক এবং ঘটনাক্রমে যদি কারো নাম ও কর্মের সহিত মিলে যায়, তা সমস্তই অনিচ্ছাকৃত 


রিফারেন্স


প্রতীচ্যের সাহিত্য তত্ব – তপোধীর ভট্টাচার্য

কবিতা নিয়ে – হিমবন্ত বন্দোপাধ্যায়

কবিতার মুহূর্ত – শংখ ঘোষ

কবিতার কথা – জীবনানন্দ দাশ

অতিচেতনার কথা – বারীন ঘোষাল

বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত – ডঃ অসিত বন্দোপাধ্যায়

অভিধান: http://www.ovidhan.org/, http://www.english-bangla.com/bntobn/index/

নাম্বার: https://www.humanbenchmark.com/tests/number-memory

ম্যাসিন লার্নিং: https://machinelearningmastery.com/master-machine-learning-algorithms/

কবিতা: https://www.weforum.org/agenda/2018/04/artificial-intelligence-writes-bad-poems-just-like-an-angsty-teen

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স: https://www.investopedia.com/terms/a/artificial-intelligence-ai.asp

এন এল পিঁঃ https://algorithmia.com/blog/introduction-natural-language-processing-nlp

করপাসঃ https://hub.packtpub.com/python-text-processing-nltk-20-creating-custom-corpora/