Friday, 25 April 2025

ব্যক্তিগত বিশ্বাস

 

ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সমষ্টিগত বোঝাপড়া: আধুনিক ভারতে ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথ সন্ধান








ভূমিকা: পরিচয়ের বহুমাত্রিক বুনন

ভারতের নাগরিক হিসেবে, পরিচয়ের জটিল বুননকে বোঝা এবং তার মধ্যে দিয়ে পথ চলা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা। আমরা প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী, বিভিন্ন ধর্ম (বা নিরীশ্বরবাদ) পালনকারী, অসংখ্য ভাষার বক্তা এবং একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিক যা একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে সমুন্নত রাখার জন্য সচেষ্ট। এই জটিল মিথস্ক্রিয়া প্রায়শই আমাদের সংযোগগুলির প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর আত্মদর্শনে চালিত করে। এই প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তু এমনই একটি চিন্তাভাবনা, যা একটি অনুভূত দ্বৈততার উপর কেন্দ্রীভূত: ধারণাটি হলো, ধার্মিক হওয়া একটি অপরিহার্যভাবে একক সত্তার বিষয়, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া একটি মৌলিকভাবে বহুত্ববাদী বিষয়।

এই দৃষ্টিকোণ প্রস্তাব করে যে ধর্মীয় বিশ্বাস – তার অনুভূতি, অনুশীলন এবং অভ্যন্তরীণ প্রত্যয় – ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকতে পারে, যা ব্যক্তি এবং পবিত্র সত্তার মধ্যে একটি গভীর ব্যক্তিগত সংলাপ, যা সম্ভাব্যভাবে অন্য কোনও ব্যক্তির থেকে স্বাধীন। এটি একটি অভ্যন্তরীণ অবস্থা, ব্যক্তিগত কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়িত একটি ব্যক্তিগত প্রত্যয়। ধর্মনিরপেক্ষতা, বিপরীতভাবে, বহুত্বের দাবি করে। এটি একাকী চিন্তাভাবনা থেকে উদ্ভূত হয় না, বরং বিভিন্ন সত্তার – ব্যক্তি, সম্প্রদায়, ধর্মীয় গোষ্ঠী – পারস্পরিক ক্রিয়া থেকে জন্মায়, যাদের অবশ্যই সচেতনভাবে আলোচনা করতে হয়, পারস্পরিক সম্মানের বিষয়ে একমত হতে হয় এবং একটি সাধারণ ছাতার নীচে সহাবস্থানের জন্য একে অপরকে স্থান দিতে হয়, যেমন জাতীয় ঐক্য, শান্তি এবং অগ্রগতির মতো مشترکہ مفادات (সাধারণ স্বার্থ) অনুসরণ করার জন্য। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি, এই দৃষ্টিতে, 'অন্যের' উপস্থিতি এবং সেই পার্থক্যকে গঠনমূলকভাবে পরিচালনা করার জন্য একটি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা বোঝায়।

এই নিবন্ধটি এই উপলব্ধিভিত্তিক কাঠামোকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করবে। এটি ব্যক্তিগত ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে সম্ভাব্য একক এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্তর্নিহিতভাবে বহুত্ববাদী হিসাবে দেখার বৈধতা এবং প্রভাবগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবে, বিশেষ করে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে। এটি পরীক্ষা করবে কিভাবে এই গতিশীলতা সংখ্যালঘুদের মুখোমুখি হওয়া বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যোগ্যতা ও অবদানের অপরিহার্যতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও অনমনীয়তার ক্ষতিকর প্রভাবগুলির পটভূমিতে কাজ করে। পরিশেষে, এটি যুক্তি দেবে যে যদিও একাকী বিশ্বাসের সম্ভাবনা বিদ্যমান, ভারতের মতো একটি বৈচিত্র্যময় জাতির মধ্যে এর স্বাস্থ্যকর প্রকাশ ধর্মনিরপেক্ষতার সমষ্টিগত, আলোচনার মাধ্যমে স্থিরীকৃত বাস্তবতার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। অন্তর্ভুক্তি, পরিমিতি এবং অভিযোজনের ইচ্ছা গ্রহণ করা কেবল আকাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য নয়, বরং ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং জাতীয় প্রকল্প উভয়ের টিকে থাকা ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত। বিশ্বাসের কঠোর ব্যাখ্যা, বিপরীতভাবে, সামাজিক সম্প্রীতি এবং মানব অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করে, প্রমাণ করে যে আমাদের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে চরমপন্থার জন্য খুব কমই জায়গা আছে।

বিভাগ ১: ব্যক্তিগত বিশ্বাসের এককতা – একটি অভ্যন্তরীণ মহাবিশ্ব

ধর্মীয় অভিজ্ঞতা একক হতে পারে এই দাবিটির যথেষ্ট স্বজ্ঞাত এবং দার্শনিক ওজন রয়েছে। এর মূলে, বিশ্বাস প্রায়শই একটি অভ্যন্তরীণ প্রত্যয়, ঐশ্বরিক সত্তার সাথে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সত্যের একটি বিষয়গত উপলব্ধি এবং একটি ব্যক্তিগত নৈতিক কম্পাস জড়িত করে।

  • অন্তরের ক্ষেত্র (The Internal Forum): ধর্ম প্রায়শই মানব অস্তিত্বের গভীরতম দিকগুলিকে সম্বোধন করে – অর্থ, উদ্দেশ্য, মরণশীলতা এবং অতীন্দ্রিয়তার প্রশ্ন। পবিত্র সত্তার সাথে সংলাপ, তা ব্যক্তিগত ঈশ্বর, এক নৈর্ব্যক্তিক শক্তি বা নৈতিক নীতির একটি সেট হিসাবে কল্পিত হোক না কেন, প্রাথমিকভাবে ব্যক্তির চেতনার মধ্যে ঘটে। প্রার্থনা, ধ্যান, মনন এবং ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন – এই সবই গভীর একাকী কাজ হতে পারে। একজন হিন্দু তার বাড়ির শান্ত পরিবেশে জপ করছেন, একজন মুসলমান একাকী সালাত (নামাজ) আদায় করছেন, একজন খ্রিস্টান নীরব প্রার্থনায় মগ্ন, একজন বৌদ্ধ মননশীলতার ধ্যান করছেন – এগুলি একক স্থানে ধর্মীয় অনুশীলনের শক্তিশালী উদাহরণ, যার জন্য কোনও তাৎক্ষণিক শ্রোতা বা মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন নেই। ভক্তি, বিস্ময়, অনুশোচনা বা আধ্যাত্মিক শান্তির অনুভূতি তীব্রভাবে ব্যক্তিগত।

  • বিশ্বাসের স্বায়ত্তশাসন (Autonomy of Belief): বিবেকের স্বাধীনতা, আধুনিক মানবাধিকারের একটি ভিত্তিপ্রস্তর, এই এককতাকে স্পষ্টভাবে স্বীকার করে। বিশ্বাসকে সত্যই জোর করা যায় না; এটি ব্যক্তির মধ্যে বাস করে। কেউ বাহ্যিকভাবে আনুগত্য প্রকাশ করতে পারে কিন্তু অন্তরে ভিন্নমত পোষণ করতে পারে। ধর্মীয় পরিচয়ের সবচেয়ে খাঁটি রূপ, যুক্তিযুক্তভাবে, এই অভ্যন্তরীণ সম্মতি, যা সাম্প্রদায়িক বৈধতা বা এমনকি সচেতনতা ছাড়াই বিদ্যমান থাকতে পারে। কেউ মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা গুরুদ্বারে পা না রেখেও গভীরভাবে ধার্মিক বোধ করতে পারে, ব্যক্তিগত অধ্যয়ন, প্রতিফলন এবং দৈনন্দিন জীবনে অনুভূত ঐশ্বরিক আদেশের প্রতি আনুগত্য থেকে আধ্যাত্মিক পুষ্টি অর্জন করতে পারে।

  • অস্তিত্বগত একাকীত্ব (Existential Solitude): ধর্ম প্রায়শই মৌলিক মানব একাকীত্ব – আমাদের পৃথক অস্তিত্ব এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর সচেতনতা – মোকাবেলা করার জন্য উত্তর বা কাঠামো সরবরাহ করে। এই অর্থে, ধর্মীয় যাত্রাকে এই অস্তিত্বগত বাস্তবতার মুখে অর্থ এবং সংযোগের জন্য একটি গভীর স্বতন্ত্র অনুসন্ধান হিসাবে দেখা যেতে পারে, একটি সংলাপ যা প্রাথমিকভাবে ব্যক্তি এবং পরম সত্তার মধ্যে পরিচালিত হয়।

যাইহোক, এই এককতা ধারণাটিকে সূক্ষ্মভাবে বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও একাকী অনুশীলন এবং অভ্যন্তরীণ প্রত্যয়ের সম্ভাবনা অনস্বীকার্য, বেশিরভাগ ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলিও সাম্প্রদায়িক কাঠামো, আচার-অনুষ্ঠান এবং আখ্যানগুলির মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।

  • সম্প্রদায়ের ভূমিকা (সংঘ, উম্মাহ, চার্চ): ধর্মগুলিতে সাধারণত ভাগ করা ধর্মগ্রন্থ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা ঐতিহ্য, সাম্প্রদায়িক উপাসনা, জীবনচক্রের আচার-অনুষ্ঠান (জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু) এবং প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। এই উপাদানগুলি সহজাতভাবে একটি বহুত্ববাদী মাত্রা প্রবর্তন করে। পবিত্র গ্রন্থগুলির ব্যাখ্যা প্রায়শই পাণ্ডিত্যপূর্ণ ঐতিহ্য এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। উৎসব এবং তীর্থযাত্রাগুলি হল সম্মিলিত অভিজ্ঞতা যা গোষ্ঠী পরিচয় এবং ভাগ করা বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। বিশ্বাস প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত ভাষা এবং ধারণাগুলিও সামাজিকভাবে শেখা হয়।

  • নৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া: বেশিরভাগ ধর্ম নৈতিক বিধি নির্ধারণ করে যা অন্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। করুণা, দান (যাকাত, সেবা), ন্যায়বিচার এবং ক্ষমার মতো ধারণাগুলি সহজাতভাবে অন্য লোকেদের সাথে সম্পর্কিত হওয়া জড়িত। এই গুণাবলী অনুশীলন করা ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র থেকে সামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ে যায়।

অতএব, যদিও বিশ্বাসের মূল অভিজ্ঞতা বা অভ্যন্তরীণ প্রত্যয় গভীরভাব একক এবং ব্যক্তিগত হতে পারে, তবে বেশিরভাগ অনুসারীর জন্য এর জীবন্ত বাস্তবতা একটি সম্প্রদায় এবং একটি ঐতিহ্যের সাথে উল্লেখযোগ্য মিথস্ক্রিয়া জড়িত। ব্যবহারকারীর অন্তর্দৃষ্টি এককতাকে একটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হিসাবে সম্ভাবনা তুলে ধরে – এই সত্য যে ধর্ম একাই অনুভব করা এবং অনুশীলন করা যেতে পারে, ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে, যা ধারণাগতভাবে বহুত্ব ছাড়া বিদ্যমান থাকতে পারে না। এই পার্থক্যটি বেশিরভাগ ধর্মের সাম্প্রদায়িক দিকগুলি স্বীকার করার পরেও মূল্যবান থেকে যায়। বিশ্বাসের সারাংশ একজনের মধ্যে থাকতে পারে, যখন ধর্মনিরপেক্ষতার সারাংশ অনেকের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে নিহিত।

বিভাগ ২: ধর্মনিরপেক্ষতা একটি প্রয়োজনীয় বহুত্ববাদ – সমষ্টিগত চুক্তি

যদি ব্যক্তিগত বিশ্বাস একক হতে পারে, ধর্মনিরপেক্ষতা, তার সংজ্ঞা এবং কার্যকারিতা অনুসারে, অবশ্যই বহুত্ববাদী হতে হবে। এটি একটি ধারণা যা বৈচিত্র্য, বিশেষ করে ধর্মীয় বৈচিত্র্য, একটি একক রাজনৈতিক সত্তার মধ্যে পরিচালনা করার প্রয়োজন থেকে জন্ম নিয়েছে। এটি বিশ্বাসের মতো মনের একটি অভ্যন্তরীণ অবস্থা নয়, বরং সহাবস্থানের জন্য একটি কাঠামো, একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা।

  • বৈচিত্র্যের মধ্যে জন্ম (The Genesis in Diversity): ধর্মনিরপেক্ষতা ঐতিহাসিকভাবে এবং ধারণাগতভাবে আবির্ভূত হয় কারণ সমাজগুলি ধর্মীয়ভাবে একশিলা (monolithic) নয়। যখন একাধিক ধর্মীয় সম্প্রদায় (এবং যাদের কোনো ধর্ম নেই) একই অঞ্চলে বাস করে এবং একই শাসনের অধীনে আসে, তখন শান্তি, শৃঙ্খলা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য একটি ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। এই ব্যবস্থাটি হল ধর্মনিরপেক্ষতা। এর প্রাথমিক কাজ হল রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করা, এবং ফলস্বরূপ, জনসাধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করা। এর জন্য ন্যূনতম দুটি স্বতন্ত্র সত্তার প্রয়োজন (যেমন, রাষ্ট্র এবং ধর্ম, বা ধর্ম ক এবং ধর্ম খ) যাদের মিথস্ক্রিয়া মধ্যস্থতাকারী নীতির প্রয়োজন।

  • ভারতীয় মডেল: নীতিগত দূরত্ব এবং সমান শ্রদ্ধা (Principled Distance and Equal Respect): কিছু পশ্চিমা মডেলের মতো যা একটি কঠোর "বিচ্ছেদের প্রাচীর" (wall of separation) এর উপর জোর দেয়, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানে সন্নিবেশিত এবং বিচার বিভাগ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সর্ব ধর্ম সম ভাব (সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা) এবং "নীতিগত দূরত্ব" এর মতো ধারণাগুলিকে ধারণ করে। রাষ্ট্র কোনও ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে না (ধারা ২৭ কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রচারের জন্য কর আরোপ প্রতিরোধ করে), বিবেকের স্বাধীনতা এবং ধর্ম স্বীকার, পালন ও প্রচারের অধিকার নিশ্চিত করে (ধারা ২৫), এবং ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করে (ধারা ১৫)। এটি সামাজিক সংস্কার এবং ধর্মীয় অনুশীলনের সাথে যুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ কার্যকলাপগুলি নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকারও সংরক্ষণ করে (ধারা ২৫(২))। এই মডেলটি সহজাতভাবে একাধিক ধর্মের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং তাদের সকলের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে, যার লক্ষ্য নিরপেক্ষতা এবং সংখ্যালঘু অধিকারের সুরক্ষা সহ সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুশীলন। এর জন্য প্রয়োজন ধ্রুবক আলোচনা এবং ভারসাম্য রক্ষা – একটি বহুত্ববাদী প্রচেষ্টা।

  • সহাবস্থানের সামাজিক চুক্তি (The Social Contract of Coexistence): ধর্মনিরপেক্ষতা বৈচিত্র্যময় নাগরিকদের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তি হিসাবে কাজ করে। এটি একটি পারস্পরিক চুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে, প্রায়শই অন্তর্নিহিত কিন্তু আদর্শগতভাবে সুস্পষ্ট এবং সাংবিধানিকভাবে ভিত্তিযুক্ত, একে অপরকে তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস অনুশীলন করার (জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং স্বাস্থ্যের সীমার মধ্যে) এবং জাতির জীবনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করার স্থান দেওয়ার জন্য। এই চুক্তি স্থির নয়; এটি সংলাপ, সামঞ্জস্য এবং পুনর্নিশ্চিতকরণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি সমস্ত গোষ্ঠীর কাছ থেকে ভাগ করা নীতিগুলি সমুন্নত রাখার জন্য সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং প্রতিশ্রুতি দাবি করে। উল্লেখিত "সাধারণ স্বার্থ" – জাতি, স্বয়ং ভারত – সেই উচ্চতর লক্ষ্যে পরিণত হয় যা এই পারস্পরিক বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে। একাধিক গোষ্ঠীর এই চুক্তিতে মেনে চলার ইচ্ছা ছাড়া, ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো সংঘাত বা সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যে ভেঙে পড়ে।

  • ধর্মনিরপেক্ষতা একটি জনসাধারণের গুণ হিসাবে (Secularism as a Public Virtue): যদিও বিশ্বাস ব্যক্তিগত হতে পারে, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাথমিকভাবে জনসাধারণের ক্ষেত্র – আইন, শাসন, শিক্ষা, পাবলিক স্পেস – নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটি নির্দেশ করে যে পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলি সমস্ত নাগরিকের কাছে অ্যাক্সেসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হওয়া উচিত, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে। এর জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ভাগ করা বোঝাপড়া এবং প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন, যা এর বহুত্ববাদী প্রকৃতিকে শক্তিশালী করে। এটি দাবি করে যে নাগরিকরা একে অপরের সাথে প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে নয়, বরং রাজনীতির সমান সদস্য হিসাবে মিথস্ক্রিয়া করে।

অতএব, ব্যবহারকারীর উপলব্ধি সঠিক: ধর্মনিরপেক্ষতা মৌলিকভাবে বহুত্ববাদ পরিচালনার বিষয়ে। এটি বৈচিত্র্যকে পূর্বানুমান করে এবং কার্যকারিতার জন্য অবিচ্ছিন্ন, সমষ্টিগত প্রচেষ্টা – আলোচনা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আপোষ এবং ভাগ করা সাংবিধানিক নীতিগুলির প্রতি আনুগত্য – প্রয়োজন। এটি অনেকের জন্য একটি কাঠামো, যা অনেকের দ্বারা নির্মিত।

বিভাগ ৩: সংখ্যালঘুদের টিকে থাকা, যোগ্যতা এবং অবদান একটি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে

বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘুদের জন্য টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে এই পর্যবেক্ষণ, যা একটি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব গতিশীলতার সাথে যুক্ত, ক্ষমতা, কুসংস্কার এবং আর্থ-সামাজিক চাপের জটিল বাস্তবতার উপর আলোকপাত করে। প্রস্তাবিত নিদান – যে টিকে থাকার জন্য যোগ্যতার প্রয়োজন, এবং দৃশ্যমানতার জন্য ইতিবাচক অবদানের প্রয়োজন – ধর্মনিরপেক্ষতার প্রেক্ষাপটে সতর্ক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

  • প্রতিযোগিতামূলক প্রেক্ষাপট এবং সংখ্যালঘুদের দুর্বলতা: ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়িত এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে, সম্পদ (অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক মূলধন) প্রায়শই দুষ্প্রাপ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি ধর্মীয় সহ বিদ্যমান বিভেদ রেখাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। সংখ্যালঘু, যাদের প্রায়শই সংখ্যাগত শক্তি এবং ক্ষমতার কাঠামোতে ঐতিহাসিক অ্যাক্সেস কম থাকে, তারা বৈষম্য, বলির পাঁঠা বানানো এবং প্রান্তিককরণের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে। অর্থনৈতিক উদ্বেগগুলি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উপর চাপানো হতে পারে, এবং রাজনৈতিক কুশীলবরা সংঘবদ্ধকরণের জন্য ধর্মীয় পার্থক্যকে কাজে লাগাতে পারে। এই বাস্তবতা সংখ্যালঘুদের প্রায়শই মুখোমুখি হওয়া দুর্বলতাকে তুলে ধরে, যা তাদের নিরাপত্তা এবং সমতার সংগ্রামকে বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।

  • যোগ্যতা এবং অবদান: প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট কি? যোগ্যতা টিকে থাকার দিকে পরিচালিত করে এবং অবদান দৃশ্যমানতা ও সম্মানের দিকে পরিচালিত করে এই ধারণাটির যোগ্যতা রয়েছে। যেকোনো ক্ষেত্রে প্রদর্শনযোগ্য দক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করতে পারে, তাদের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে সফলভাবে পথ চলতে সক্ষম করে। একইভাবে, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং জনজীবনে উল্লেখযোগ্য অবদান সদিচ্ছা তৈরি করতে পারে, নেতিবাচক স্টেরিওটাইপগুলিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং একটি সম্প্রদায়ের জন্য সম্মান অর্জন করতে পারে। ভারতীয় ইতিহাস এবং সমসাময়িক জীবনে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি অমূল্য অবদান রেখেছে, জাতিকে প্রচুরভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তাদের যোগ্যতা এবং অর্জনগুলি নিঃসন্দেহে তাদের অবস্থান এবং দৃশ্যমানতাকে শক্তিশালী করে।

তবে, সংখ্যালঘুদের টিকে থাকা এবং সম্মানের নিশ্চয়তা হিসাবে কেবল যোগ্যতা এবং অবদানের উপর নির্ভর করা সমস্যাযুক্ত এবং সম্ভাব্যভাবে বোঝাটিকে অন্যায়ভাবে স্থানান্তর করে।

  • অধিকার বনাম যোগ্যতা (Rights vs. Merit): একটি ন্যায়সঙ্গত এবং ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ সংখ্যালঘু সহ সকল নাগরিকের অধিকার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করে, তাদের অনুভূত "যোগ্যতা" বা "অবদান" এর স্তর নির্বিশেষে। টিকে থাকা এবং মর্যাদা অন্তর্নিহিত মানবাধিকার এবং নাগরিকত্বের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত, ব্যতিক্রমী কর্মক্ষমতার মাধ্যমে নিজের মূল্য বা উপযোগিতা প্রমাণ করার ধ্রুবক প্রয়োজনের উপর নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি হ'ল একটি সমান ক্ষেত্র তৈরি করা যেখানে অধিকারগুলি নিশ্চিত করা হয়, ব্যতিক্রমী কর্মক্ষমতার মাধ্যমে অর্জিত হয় না।

  • কাঠামোগত বাধা এবং বৈষম্য (Systemic Barriers and Discrimination): সংখ্যালঘুরা প্রায়শই কাঠামোগত বৈষম্য, ঐতিহাসিক অসুবিধা এবং কুসংস্কারের মুখোমুখি হয় যা তাদের ন্যায্যভাবে প্রতিযোগিতা করার বা তাদের অবদানকে স্বীকৃতি পেতে বাধা দেয়। মানসম্পন্ন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সংস্থান বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অ্যাক্সেসের অভাব উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি করতে পারে। এমনকি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অত্যন্ত যোগ্য এবং অবদানকারী সদস্যরাও অদৃশ্য বাধা (glass ceiling) বা পক্ষপাতদুষ্ট ধারণার মুখোমুখি হতে পারে। অতএব, এই অন্তর্নিহিত কাঠামোগত অসমতাগুলিকে মোকাবেলা না করে যোগ্যতা এবং অবদানের দাবি করা অপর্যাপ্ত।

  • দৃশ্যমানতা একটি দ্বিমুখী তলোয়ার হিসাবে (Visibility as a Double-Edged Sword): যদিও ইতিবাচক অবদান দৃশ্যমানতা এবং সম্মান বাড়াতে পারে, দৃশ্যমানতা সংখ্যালঘুদের শত্রুতার লক্ষ্যেও পরিণত করতে পারে, বিশেষ করে মেরুকৃত পরিবেশে। সাফল্য কখনও কখনও বিরক্তি তৈরি করতে পারে বা বিভেদ সৃষ্টিকারী আখ্যান প্রচারকারীদের দ্বারা সন্দেহজনকভাবে চিত্রিত হতে পারে।

অতএব, যদিও সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগ্যতা বৃদ্ধি করা এবং সমাজে ইতিবাচক অবদানকে উৎসাহিত করা নিঃসন্দেহে উপকারী, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা এবং অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ নীতি এবং সাংবিধানিক নিশ্চয়তার শক্তিশালী বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করতে হবে। রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হল তার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা এবং তাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বা অনুভূত অবদানের স্তর নির্বিশেষে তাদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। "প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের শৃঙ্খল প্রভাব" (chain effect of the competitive world) অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোতে অন্তর্নিহিত ন্যায়বিচার এবং সমতার নীতিগুলির দ্বারা প্রশমিত হতে হবে, সংখ্যালঘু দুর্বলতার জন্য একটি অপরিবর্তনীয় ন্যায্যতা হিসাবে গ্রহণ করা উচিত নয়।

বিভাগ ৪: অসহিষ্ণুতা এবং অনমনীয়তার প্রতিবন্ধকতা

ব্যবহারকারীর দাবি যে "কেবল একটি ধর্ম পালন করা এবং অন্যকে সহ্য না করা আপনার সম্প্রদায়কে শক্তিশালী, দৃশ্যমান এবং সম্মানিত করে না" একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি। উপরন্তু, এই বিবৃতি যে "একটি কঠোর ধর্মীয় অনুশীলন ধর্মনিরপেক্ষতা অর্জনের পথে একটি বাধা এবং মানবতার অগ্রগতির বিপরীত" কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রকাশের রূপ এবং একটি বহুত্ববাদী, আধুনিক সমাজের চাহিদার মধ্যেকার সংঘাতের দিকে সরাসরি নির্দেশ করে।

  • অসহিষ্ণুতা শক্তি এবং সম্মানকে দুর্বল করে: অসহিষ্ণুতা, নিজের থেকে ভিন্ন বিশ্বাস এবং অনুশীলনগুলি গ্রহণ বা সম্মান করতে অস্বীকার করা, সহজাতভাবে দুর্বল করে তোলে, উভয়ই এটি অনুশীলনকারী সম্প্রদায়ের জন্য এবং বৃহত্তর সমাজের জন্য।

    • অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুরতা: অসহিষ্ণু সম্প্রদায়গুলি প্রায়শই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, নতুন ধারণার প্রতি প্রতিরোধী হয় এবং সীমানা নির্ধারণে মনোনিবেশ করে। এটি অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং অভিযোজনকে দমন করতে পারে, যা শক্তির পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক স্থবিরতার দিকে পরিচালিত করে।

    • বাহ্যিক সংঘাত: অসহিষ্ণুতা অনিবার্যভাবে সন্দেহ, ভয়, বিরক্তি এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে সংঘাতের জন্ম দেয়। এটি জোট গঠন প্রতিরোধ করে, সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলিতে সহযোগিতায় বাধা দেয় এবং সামাজিক সংহতির ক্ষতি করে। অসহিষ্ণু হিসাবে বিবেচিত একটি সম্প্রদায় অন্যদের কাছ থেকে প্রকৃত সম্মান বা বিশ্বাস অর্জন করার সম্ভাবনা কম; এটি ভীত বা শান্ত করা হতে পারে, কিন্তু সম্মানিত নয়।

    • নৈতিক ঘাটতি: ক্রমবর্ধমানভাবে সর্বজনীন মানবাধিকার এবং বৈচিত্র্যের মূল্য সম্পর্কে সচেতন বিশ্বে, অসহিষ্ণুতা একটি উল্লেখযোগ্য নৈতিক ঘাটতি বহন করে। এটি সহানুভূতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিগুলির বিরোধিতা করে যা একটি মানবিক সমাজের জন্য অপরিহার্য হিসাবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়।

  • অনমনীয়তা ধর্মনিরপেক্ষতার বাধা হিসাবে: কঠোর ধর্মীয় অনুশীলন – যা আক্ষরিক ব্যাখ্যা, ধর্মান্ধতা, পরিবর্তনের প্রতিরোধ, জনসাধারণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিয়ম চাপিয়ে দেওয়ার জেদ এবং বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান দ্বারা চিহ্নিত – ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

    • বহুত্ববাদ প্রত্যাখ্যান: অনমনীয়তা প্রায়শই অন্যান্য ধর্ম বা জীবনধারার বৈধতা অস্বীকার করে, যা ধর্মনিরপেক্ষতার পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সমান স্থানের প্রয়োজনীয়তার সাথে মৌলিকভাবে বিরোধিতা করে।

    • সাংবিধানিক মূল্যবোধের সাথে সংঘাত: যখন কঠোর ধর্মীয় মতবাদগুলি সমতা (যেমন, লিঙ্গ সমতা, বর্ণ বা যৌন অভিমুখিতার ভিত্তিতে বৈষম্যহীনতা), মৌলিক অধিকার বা বৈজ্ঞানিক যুক্তির মতো সাংবিধানিক নীতিগুলির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন অনুগামীরা ধর্মনিরপেক্ষ আইনি কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করতে পারে, ছাড় দাবি করতে পারে বা আইনের মাধ্যমে তাদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

    • ভাগ করা নাগরিকত্বকে দুর্বল করা: ধর্মের উপর ভিত্তি করে কঠোর পরিচয় রাজনীতি ভাগ করা জাতীয় পরিচয়ের উপর সাম্প্রদায়িক আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দিতে পারে, যা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা নাগরিকত্বের বন্ধনকে দুর্বল করে। এটি 'অন্যকে' প্রাথমিকভাবে একটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে উৎসাহিত করে, সাধারণ মানবতা বা ভাগ করা নাগরিক লক্ষ্যগুলির উপর ভিত্তি করে মিথস্ক্রিয়ায় বাধা দেয়।

  • অনমনীয়তা মানব অগ্রগতির বিপরীত হিসাবে: মানব অগ্রগতি, বিস্তৃতভাবে কল্পিত, জ্ঞান (বৈজ্ঞানিক, সামাজিক), নীতিশাস্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সামগ্রিক সুস্থতার অগ্রগতি জড়িত। কঠোর ধর্মীয় অনুশীলন এই অগ্রগতিকে বিভিন্ন উপায়ে বাধা দিতে পারে:

    • জ্ঞানের প্রতি প্রতিরোধ: আক্ষরিক ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (যেমন, বিবর্তন, চিকিৎসা অগ্রগতি) বা সমালোচনামূলক ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের প্রত্যাখ্যানের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

    • সামাজিক সংস্কারে বাধা: ঐতিহ্যগত ব্যাখ্যার প্রতি কঠোর আনুগত্য সমতা, ন্যায়বিচার এবং ব্যক্তি স্বায়ত্তশাসন (যেমন, বর্ণ বৈষম্য, নারী অধিকার, এলজিবিটিকিউ+ অধিকার সম্পর্কিত সংস্কার) বাড়ানোর লক্ষ্যে সামাজিক সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

    • সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা দমন: প্রশ্নহীনভাবে গোঁড়ামির প্রতি আনুগত্যের উপর জোর দেওয়া সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল এবং খোলা সংলাপকে নিরুৎসাহিত করতে পারে, যা অগ্রগতির অপরিহার্য ইঞ্জিন।

    • সংঘাত উস্কে দেওয়া: যেমন আলোচনা করা হয়েছে, অনমনীয়তা প্রায়শই অসহিষ্ণুতা এবং সংঘাতকে উস্কে দেয়, গঠনমূলক উন্নয়ন এবং সহযোগিতা থেকে শক্তি এবং সম্পদকে সরিয়ে দেয়।

এটি যুক্তি দেওয়ার জন্য নয় যে সমস্ত ধর্মীয় অনুশীলন কঠোর বা বিশ্বাস নিজেই সহজাতভাবে প্রগতি-বিরোধী। অনেক ধর্মীয় ঐতিহ্যের ব্যাখ্যার, অভিযোজন এবং সংস্কারের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া রয়েছে এবং ইতিহাস জুড়ে সামাজিক ন্যায়বিচার ও করুণার আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে। সমালোচনাটি বিশেষভাবে কঠোর ব্যাখ্যা এবং অসহিষ্ণু মনোভাবের দিকে পরিচালিত যা একটি বৈচিত্র্যময় বিশ্বের বাস্তবতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ও মানবাধিকারের নীতিগুলির সাথে গঠনমূলকভাবে জড়িত হতে অস্বীকার করে।

বিভাগ ৫: অন্তর্ভুক্তি, পরিমিতি এবং পরিবর্তনের অপরিহার্যতা

অসহিষ্ণুতা এবং অনমনীয়তার দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলির পরিপ্রেক্ষিতে, একটি সুরেলা এবং প্রগতিশীল সমাজের দিকে পথ, বিশেষ করে ভারতের মতো একটি বৈচিত্র্যময় দেশে, অন্তর্ভুক্তি, পরিমিতি এবং পরিবর্তন ও অভিযোজনের জন্য একটি প্রস্তুতির আলিঙ্গনের মধ্যে নিহিত। এগুলি কেবল ঐচ্ছিক গুণাবলী নয়; এগুলি ধর্মনিরপেক্ষ প্রকল্পের সাফল্য এবং সমস্ত নাগরিকের সুস্থতার জন্য কার্যকরী প্রয়োজনীয়তা।

  • অন্তর্ভুক্তি: সহনশীলতার বাইরে সক্রিয় অংশগ্রহণে: ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য নিছক নিষ্ক্রিয় সহনশীলতা ("বাঁচো এবং বাঁচতে দাও") এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন। প্রকৃত অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজন সক্রিয় অংশগ্রহণ, সহানুভূতি এবং আমাদের নিজেদের থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার ও উপলব্ধি করার ইচ্ছা। এর অর্থ হল সমাজকে পৃথক ধর্মীয় ব্লকের সংগ্রহ হিসাবে দেখার বাইরে গিয়ে একটি ভাগ করা পাবলিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা যেখানে ব্যক্তিরা সাধারণ মানবতা এবং নাগরিকত্বের ভিত্তিতে মিথস্ক্রিয়া করে। এর মধ্যে রয়েছে:

    • আন্তঃধর্মীয় সংলাপ: বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থপূর্ণ কথোপকথন এবং বোঝাপড়ার জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

    • বৈচিত্র্য উদযাপন: জাতীয় বুননে সমস্ত সম্প্রদায়ের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং বৈচিত্র্যকে পরিচালনা করার সমস্যা হিসাবে না দেখে শক্তি এবং সমৃদ্ধির উৎস হিসাবে দেখা।

    • ভাগ করা পাবলিক স্পেস: নিশ্চিত করা যে পাবলিক প্রতিষ্ঠান, স্থান এবং আলোচনা ধর্মীয় পক্ষপাত বা আধিপত্য থেকে মুক্ত, সকলের জন্য স্বাগত এবং অ্যাক্সেসযোগ্য।

  • পরিমিতি: বিশ্বাস, যুক্তি এবং অধিকারের ভারসাম্য রক্ষা: পরিমিতি, এই প্রেক্ষাপটে, একটি ভারসাম্য খুঁজে বের করা বোঝায়। এর অর্থ হল ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে যুক্তির সাথে একীভূত করা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে সম্মান করা এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ও সাংবিধানিক নীতিগুলি সমুন্নত রাখা। এর মধ্যে রয়েছে:

    • প্রেক্ষিত নির্ভর ব্যাখ্যা: কঠোর আক্ষরিকতা থেকে সরে এসে ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ঐতিহ্যগুলিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যা সমসাময়িক বিশ্বে প্রাসঙ্গিক এবং নৈতিক।

    • ভাগ করা মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া: স্বীকার করা যে করুণা, ন্যায়বিচার এবং সমতার মতো মূল মানবিক মূল্যবোধগুলি প্রায়শই নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবাদকে অতিক্রম করে এবং সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

    • ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং পাবলিক আইনের পার্থক্য: বোঝা যে যদিও ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং অনুশীলনের অধিকার রয়েছে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পাবলিক আইন এবং নীতিগুলি অবশ্যই সমস্ত নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য এবং ন্যায্য নীতির উপর ভিত্তি করে হতে হবে, শুধুমাত্র একটি ধর্মের নীতি থেকে উদ্ভূত নয়।

  • পরিবর্তন ও অভিযোজনের জন্য প্রস্তুতি: সমাজ বিকশিত হয়, জ্ঞান প্রসারিত হয় এবং নৈতিক বোঝাপড়া গভীর হয়। ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলি, যদি তারা প্রাসঙ্গিক এবং গঠনমূলক শক্তি হিসাবে থাকতে চায়, তবে পরিবর্তন এবং অভিযোজনের ক্ষমতাও প্রদর্শন করতে হবে। এর অর্থ অগত্যা মূল বিশ্বাসগুলি পরিত্যাগ করা নয়, বরং নতুন প্রেক্ষাপট এবং বিকশিত মানবিক মূল্যবোধের আলোকে ব্যাখ্যা এবং অনুশীলনগুলি পুনর্বিবেচনা করা। যেকোনো ধরনের পরিবর্তনের প্রতিরোধ প্রায়শই নিরাপত্তাহীনতা বা প্রোথিত ক্ষমতার কাঠামো বজায় রাখার ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত হয়, কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকতা বা সংঘাতের দিকে নিয়ে যায়। অগ্রগতির জন্য সংস্কারের প্রতি উন্মুক্ততা প্রয়োজন, তা ধর্মের সাথে যুক্ত সামাজিক রীতিনীতিতে হোক বা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায়।

  • চরমপন্থা বর্জন: পরিমিতির আহ্বান সহজাতভাবে চরমপন্থা প্রত্যাখ্যান বোঝায়। চরমপন্থী মতাদর্শ, তা ধর্মীয় বা রাজনৈতিক হোক, মেরুকরণ, ঘৃণা, 'অন্যের' অমানবিকীকরণ এবং প্রায়শই সহিংসতার উপর ভর করে বৃদ্ধি পায়। এগুলি অন্তর্ভুক্তি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় যুক্তিসঙ্গত সংলাপের বিপরীত মেরুর প্রতিনিধিত্ব করে। তারা জটিল বাস্তবতাকে দ্বৈত বিরোধে (আমরা বনাম তারা, খাঁটি বনাম অপবিত্র) সরল করে এবং উগ্র, প্রায়শই হিংসাত্মক, সমাধান প্রস্তাব করে। একটি সুস্থ ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে অবশ্যই সক্রিয়ভাবে চিহ্নিত করতে হবে, চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং চরমপন্থী আখ্যান এবং কুশীলবদের প্রান্তিক করতে হবে যারা সামাজিক সম্প্রীতি এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে দুর্বল করতে চায়। ব্যবহারকারী যেমন সঠিকভাবে উপসংহারে পৌঁছেছেন, "বর্তমান বিশ্বে চরমপন্থীদের জন্য কোনও স্থান নেই" যদি আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অগ্রগতির আকাঙ্ক্ষা করি।

এটি অর্জনের জন্য ব্যক্তি, সম্প্রদায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ সংগঠন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বৃদ্ধি করা, সাংবিধানিক সাক্ষরতা প্রচার করা, আন্তঃ-সম্প্রদায় মিথস্ক্রিয়াকে উৎসাহিত করা এবং পপুলিস্ট চাপ বা সাম্প্রদায়িক উস্কানির মুখেও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিগুলি দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা।

উপসংহার: একক সত্তাকে বহুত্ববাদী বুননে বোনা

প্রাথমিক প্রতিফলন – যে ধর্মীয় অনুভূতি একক হতে পারে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা আবশ্যিকভাবে বহুত্ববাদী – ভারতের বিশ্বাস এবং নাগরিকত্বের গতিশীলতা বোঝার জন্য একটি মূল্যবান লেন্স সরবরাহ করে। বিশ্বাসের অভ্যন্তরীণ, ব্যক্তিগত মাত্রা লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য গভীর অর্থ এবং সান্ত্বনা প্রদান করে, যা ব্যক্তির মধ্যে একটি মহাবিশ্ব। তবুও, যে মুহূর্তে এই বিশ্বাস সমাজের ভাগ করা স্থানে প্রবেশ করে, বিশেষ করে ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় সমাজে, এটি বহুত্ববাদের অ-আলোচনাযোগ্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।

ধর্মনিরপেক্ষতা হল সাংবিধানিক এবং সামাজিক স্থাপত্য যা এই বহুত্ববাদকে গঠনমূলকভাবে পরিচালনা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি ধর্ম-বিরোধী নয়, বরং একটি কাঠামো যা বিভিন্ন ধর্মকে (এবং অধর্মকে) একটি সাধারণ জাতীয় পরিচয়ের অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে দেয়, নিশ্চিত করে যে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকে এবং সমস্ত নাগরিকের, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে। এটি একটি সমষ্টিগত চুক্তি, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, চলমান আলোচনা এবং সাধারণ ভালোর – স্বয়ং জাতির – প্রতি একটি ভাগ করা প্রতিশ্রুতি দাবি করে।

চ্যালেঞ্জগুলি দেখা দেয় যখন বিশ্বাসের সম্ভাব্য এককতা একটি বর্জনীয় এবং অনমনীয় গোষ্ঠী পরিচয়ে রূপান্তরিত হয়, যা পার্থক্যের প্রতি অসহিষ্ণু এবং ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর দ্বারা প্রয়োজনীয় বাসস্থানের প্রতি প্রতিরোধী। এই ধরনের অনমনীয়তা, যেমন বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কেবল ধর্মনিরপেক্ষতার কার্যকারিতাকেই বাধা দেয় না, বরং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে দমন করে, সামাজিক সংস্কারে বাধা দিয়ে এবং সংঘাতকে উস্কে দিয়ে বৃহত্তর মানব অগ্রগতিকেও বাধা দেয়। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য যোগ্যতার প্রয়োজন, এবং দৃশ্যমানতার জন্য অবদানের প্রয়োজন, এই দাবিটি আংশিকভাবে সত্য হলেও, এই মৌলিক নীতিটিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে অধিকার এবং নিরাপত্তা অন্তর্নিহিত, ব্যতিক্রমীতার মাধ্যমে অর্জিত নয়। কাঠামোটিকে অবশ্যই সকলকে রক্ষা করতে হবে, তাদের ন্যায্যভাবে প্রতিযোগিতা এবং অবদান রাখতে সক্ষম করতে হবে।

পরিশেষে, ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য এবং এর সমাজের সম্প্রীতি এই মিথস্ক্রিয়াকে সফলভাবে পরিচালনা করার উপর নির্ভর করে। এর জন্য ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়গুলিকে এমন এক ধরনের ধর্মীয় পরিচয় গড়ে তুলতে হবে যা বহুত্ববাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ – যা ব্যক্তিগত প্রত্যয়কে অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা, ঐতিহ্যকে যুক্তির সাথে এবং সাম্প্রদায়িক অনুষঙ্গকে জাতীয় নাগরিকত্বের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখে। এটি কেবল সহনশীলতা নয়, অন্তর্ভুক্তির আলিঙ্গন এবং চরমপন্থার উপর পরিমিতির প্রতি প্রতিশ্রুতি দাবি করে। অভিযোজিত হওয়ার প্রস্তুতি, সংলাপে নিযুক্ত হওয়া এবং ভাগ করা মানবিক মূল্যবোধ ও সাংবিধানিক নীতিগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

একক বিশ্বাসের অভিজ্ঞতা ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তিশালী, বহুত্ববাদী কাঠামোর মধ্যে তার সবচেয়ে নিরাপদ এবং ইতিবাচক প্রকাশ খুঁজে পায়। এই কাঠামোকে রক্ষা করা এবং শক্তিশালী করা কেবল রাষ্ট্রের কাজ নয়, বরং প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের একটি সমষ্টিগত দায়িত্ব যারা তাদের ব্যক্তিগত পরিচয় এবং জাতির ভাগ করা ভবিষ্যত উভয়কেই মূল্য দেয়। এই একক বিশ্বাসের সুতোগুলিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় বুননে বোনার মধ্যেই ভারতের প্রকৃত শক্তি এবং স্থিতিস্থাপকতা নিহিত।

Tuesday, 23 June 2020

জানালার ওপারে জানালা

ওপারে আকাশ থাকতে পারে ভেবে, আমি যেই জানালা খুলেছি । দেখি ওপারে আর একটা জানালা । আমি চোখ মুছে ভাবি, জানালা খুলবে । এই খুলে যাবে তার কপাট । একটি পড়শীর দেখা পাবো ।  

জানালাটা আমি প্রায়ই এখন খুলে খুলে দেখছি । সূর্যের আলো এসে পড়ে , পাখিদের ডাক শুনি । এই জ্যোষ্ঠের নিদাঘে শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি শুনি । জানালাটা তবু খোলে না । সে পড়শীকে আমার দেখা হবে কি?  আমার ধারনা,  এই পড়শী চাঁদকা টুকড়া হতে পারে না । সে কোন রাজকুমারীও নয় । যদি হতো, তার অন্য প্রেমিক দেখার সখ হতো । সে জানালার কপাট খুলে, এই সব পাখির হলুদ, পাতার সবুজ, রোদের হাটু গেড়ে বসা, এই সব দেখতে চাইতো । 


 এতোদিনে আমার বদ্ধ ধারণা হয়েছে,  এই পড়শী আমার মতোই হতভম্ভ, কনফিজড । সে জানলাটা এই কারনেই রেখেছে যাতে সে বোঝাতে পারে যে জানালা খোলার সময় তার নেই । নিজের মধ্যেই সে আটকে পড়েছে । সে ইচ্ছে করেই জানালাটা খোলে না । অন্য পড়শীরা যতই তাকে ঈর্শা করে, অন্য বন্ধুরা তাকে উপেক্ষা করে । হতে পারে সে আমারই মতো । জানালা রেখেছি, তবু খুলতে নারাজ ।

আমি একদিনও না দেখলাম তারে।।
বাড়ীর কাছে আরশী নগর, এক পড়শী বসত করে।।

গেরাম বেড়া অগাধ পানি; নাই কিনারা নাই তরণী পারে।।
ধরব ধরব মনে করি, কেমনে সেথা যাইরে।।

কি কব পড়শীর কথা, হস্তপদ স্কন্ধ মাথা নাইরে,
ক্ষণে থাকে শূন্য ভরে, ক্ষণে ভাসে নীরে।।

পড়শী যদি আমায় ছুতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে,
সে আর লালন একখানে রয়, লক্ষ যোজন ফাঁকরে।।
   



Sunday, 14 June 2020

সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে

আকাশে তারা উঠে ডুবে গিয়েছে । নক্ষত্ররা মরে হিম হয়ে যায়, সেটা তার জীবৎকাল, মনুষ্যকাল সেই তুলনায় নগন্য, তবু কবিদেবতাগণ আমাদের কাছে রেখেছেন এক প্রতিযোগীতার ফাঁদ । এই যে নিজেকে ছোট করে ফেলার নাম মনুষ্যজীবন , বারবার অস্বীকার করে চলেছি । আজ আরো একজন শিল্পী, সুশান্ত সিং রাজপুত একগাছা দড়ি নিয়ে অশত্থের কাছে গেলেন । অশত্থের শাখা তাঁকে আর ফিরিয়ে দিলো না । শিল্পীর জীবনে এসেছে এক প্রতিযোগীতা ।  কে সেরা হবেন , আর তাকে শ্রেষ্ট শিরোপা না দিলে, তাঁকে ডিপ্রেশনে চলে যেতে হবে । এটা কি কোন রোগ । মানুষ সেই রোগে মরে যায়, নক্ষত্রের সেই রোগ নাই । ওরা ,  আত্মহত্যা করে না । এক কালো রাত্রির অপেক্ষায় তারা ডুবে যায় । হিম হয়ে যাবার আগে, তবু তারা জ্বলে যাবে, পুড়ে যাবে , কারো ঘর আলোকিত করার জিম্মেদারী তাদের নয় । 


ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভূবনের ভার।

হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥

তুফান যদি এসে থাকে তোমার কিসের দায়--

চেয়ে দেখো ঢেউয়ের খেলা, কাজ কি ভাবনায়?

আসুক-নাকো গহন রাতি, হোক-না অন্ধকার--

হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥

পশ্চিমে তুই তাকিয়ে দেখিস মেঘে আকাশ ডোবা,

আনন্দে তুই পুবের দিকে দেখ্‌-না তারার শোভা।

সাথি যারা আছে তারা তোমার আপন ব'লে

ভাবো কি তাই রক্ষা পাবে তোমারি ওই কোলে?

উঠবে রে ঝড়, দুলবে রে বুক, জাগবে হাহাকার--

হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥

     

 
  

আজ ও হাজারখানেক চেষ্টায় পয়ারের কাজটা লাগিয়ে দেওয়া গেলো না । আমাকে তাই আরো একটা রাত্রির অপেক্ষা করতে হবে । সাইনিং অফ, কমলিকা ।




 


আমাকে লিখলেন কবি

কবিবন্ধু রাহুল গাঙ্গুলী লিখলেন আমার কবিতা নিয়ে । আমি কি যে বলি । সেই প্রথম সনেটটার কথা মনে পড়ে ?  "দুদিকে বিকেল নিয়ে দৌড়ালো বাইক" । 


কবিতা নিয়ে নানান সাধনা করে চলেছেন মানুষ । সহজ মানুষ । সহজ করে ভাবতে থাকা মানুষ । কেউ জানেন, কেউ জানেন না । কেউ পড়েছেন, কেউ পড়েন নি । পৃথিবীর প্রথম আবিষ্কারে যখন আগুন উৎপাদিত হলো ।  যিনি করলেন , তিনি কোনদিন কলকাতা দেখেন নাই । কলকাতা নামের কোন বিশ্ববিদ্যালয় আছে বলে তিনি জানতেন না । যে ভাবে,  লালন ফকির ও বোধহয় জানতেন না, রবীন্দ্রনাথ বলে একজন ঠাকুর আছেন । তবুও তিনি লিখতে পারলেন, "আমার বাড়ির কাছে আরশীনগর এক পড়শী বসত করে, আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে । "

পড়ে অনেক জানা একটি মনুষ্যআবিষ্কৃত পথ । সেইটা পড়ে আমরা কিছু কিছু জানি । যে যত পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, সুযোগ নিয়েছেন,  পিরামিডের শৃঙ্গের কাছাকাছি তার স্থান ।  তারা ঠাকুর হয়ে ওঠেন ।   


পয়ার নিয়ে নেক্সট পোস্ট দেবার আগে, রাহুলের লেখা সেই পোস্টটা একবার দেখে নেওয়া যায় । কি বলেন ?  








Saturday, 6 June 2020

খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে

কবি বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন । নিভৃতের কবি, নিসর্গের কবি, হয়ে ওঠে রণচণ্ডীর খড়গ কৃপাণ । তার কল্পলোকে পূজা হয়ে ওঠে পাষাণ , প্রেম হয়ে ওঠে শঙ্খনিনাদ ।  এই আকাশ বাতাসের মাঝে রবি নিজের স্থান করে , বিশ্বভরা প্রাণের মাঝে, তবু মনে রেখো গানটি রেখেছেন আলতো ভাবে ।  ঘরের এক কোনে পড়ে আছে মাটির কলস । কবি মন কেন যে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায় । বলে উঠতে চায়: খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে এ বিরাট শিশু আনমনে । 


খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
	শূন্যে মহা আকাশে
	মগ্ন লীলা বিলাসে,
ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে।।
তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী,
পড়িয়া আছে রাঙ্ পায়ের কাছে রাশি রাশি।
	নিত্য তুমি, হে উদার
	সুখে দুখে অবিকার,
হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে।।
 
চলুন গানটা শুনে নিই ।   





এই শিশুর নাম কমলিকা । শিশু শিখছে, খেলছে, ভাঙ্গছে । তার কবিতা লিখে ওঠার দায় নেই । সনেট হলো, না হলো । ভিলানেল হলো, না হলো , সেই বিচারের জন্য তারকা রবি শশীর খেলোয়াড় , তাদের নিজস্ব আম্পায়ার নিয়ে আছেন ।




এই খেলা, আর খেলা ভাঙার খেলা । যদি খেলবি আয়, আয়, আয় ।









ভিলানেল

এ কথা সত্য, চ্যালেঞ্জ তো নিয়ে ফেলা যায় । মুহূর্তের কাছে সময় নতজানু  হয়ে দাঁড়াইয় । নম্র মানে দুর্বল নয় । তবুও দাঁড়ায় । স্বল্প দৈর্ঘের ঝর্ণা তবুও পাড়ি দিতে চায় হিমালয় ।  এই সব উপাখ্যানের মাঝে একটা ফেসবুক পোস্টের কথা না বললেই নয় । সেটাই ট্রিগার ।  শ্রদ্ধেয় কবি স্বপন রায় , যিনি বর্তমান বাংলা ভাষার অন্যতম  শক্তিশালী কবি । তিনি 'ভিলানেল' কবিতা নিয়ে লিখলেন । পোস্ট টা এই রকমঃ   




*** কবি স্বপন রায়ের পোস্ট ***

তিক্ত রায়ের 'টাইমলাইনে' একটি ছবি আর কবিতা দিয়েছিলাম। ১৯৯৬-এ লেখা কবিতা। তাতে 'নাভিলানেল' শব্দটা ছিল। কেউ কেউ ইনবক্সে জানতে চেয়েছে এটা কীরকম শব্দ? নতুন কিছু? মানে কী? ইত্যাদি। কবিতাটা আরেকবার দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবেঃ

সূর্যহাঁক পেস্ট্রি, ভোর হল

এই তো ঘোরা-তন্ময়-জীনা, ভ্রু'তে আর

দ্রুতে ঘুরছে,ঘুরছেই উইন্ডমিল চির'র

খুলে যাবে আজ ফুরনো দেখাগুলো

'আ আ যুবনা'র আকাশগঙ্গাও দেখো গানের ভেতরে

বেকুব চাদর, হিঙ ভরা চাঁদ

নাভি আর নাভিলানেল,এইসব

তোমার সঙ্গে

কুয়াশার লবে ওঠা রোদ একটু কেঁপে উঠল

......

নাভি'র সঙ্গে 'ভিলানেল' মিশিয়ে একটা শব্দাঘাত করেছিলাম তখন 'নাভিলানেল' হিসেবে। 'ভিলানেল' একটা ছন্দের নাম। পুরোপুরি 'স্ট্রাকচারাল'। এর উৎস ষোড়শ শতাব্দীর 'রেনেশাঁ' কালীন villanella and villancico নামের নৃত্য-সংগীতে। যা ইতালি এবং স্পেনের কৃষকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তবে এর 'স্ট্রাকচারাল' রূপটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কবিতায় নিয়ে আসেন ফরাসী কবি থিওডোর-দ্য-ব্যনভিল, স্ট্রাকচারটি জটিল, ১২৩ ১২৩ ১২৩ ১২৩৪ এইভাবে তিন পংক্তির পাঁচটি স্তবক আর একটি চার পংক্তির স্তবক থাকবে 'ভিলানেল' ছন্দে এবং প্রথম আর তৃতীয় লাইনটি একটি স্তবক বাদ দিয়ে ব্যবহৃত হতে থাকবে একেবারে শেষ লাইনটিতে এবং শেষ স্তবকের শেষ দুটি লাইনে এই ব্যবহৃত লাইনগুলিকে আবার রাখতে হবে। ফরাসী কবিরা এই ছন্দে তেমন ভাবে না লিখলেও ইংরেজি ভাষার কবিতায় এর প্রয়োগ ভাল মতই করা হয়েছে। ডিলান থমাস, এলিজাবেথ বিশপ, ডব্লিউ. এইচ. অডেন, অস্কার ওয়াইল্ড, সিলভিয়া প্লাথ সহ আরো অনেকে এই ছন্দের কাঠামোয় কবিতা লিখেছেন। বাংলায় বিষ্ণু দে'র 'ভিলানেল' নামের একটি কবিতাও আছে। 'স্ট্রাকচারাল' লেখালিখিতে আমার বহুদিন ধরেই মতি নেই। তবু উদাহরণ হিসেবে আমার তাৎক্ষণিক একটি লেখা দিলামঃ

কিছুটা সময় বয়েছে তরতর
হাতের বাইরে গিয়েছে স্রোতলতা
নদীকে ভেবেছি সহসা রূপকথা

তাহলে থাকল রুচিরা অতঃপর
স্রোতল যেখানে জলজ অবনতা
কিছুটা সময় বয়েছে তরতর

কিভাবে কোথায় রেখেছে বিমোচড়
রুচিরা কেমন বিনীত অসমতা
নদীকে ভেবেছি সহসা রূপকথা

অথবা সেও কী একলা চরাচর?
সময় পায়নি ধরেনি সমগ্রতা
কিছুটা সময় বয়েছে তরতর

কপালে ঘামের অকাল স্বয়ংবর
আঙুলে পরম সহিষ্ণু অসাড়তা
নদীকে ভেবেছি সহসা রূপকথা

এসেছ যখন তখন দাহ্যভোর
গায়ে ও মাথায় নিতল শান্ত ব্যথা
কিছুটা সময় বয়েছে তরতর
নদীকে ভেবেছি সহসা রূপকথা


***পোস্ট সমাপ্ত***


এইখানে , কবিতার একটা ধারার কথা বলা হয়েছে । নাম ভিলানেল । কবিতার বিষয়ে গবেষণা করেন কবি অনিন্দ্য রায় সেই পোস্টে কামেন্ট করেন এই রকমঃ 


*** কবি অনিন্দ রায়ের কামেন্ট ***
 

উনিশ পঙ্‌ক্তির কবিতা ভিলানেল, ছয়টি স্তবকের। প্রথম পাঁচটি স্তবক তিন পঙ্‌ক্তির এবং শেষেরটি চার পঙ্‌ক্তির।
প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় পঙ্‌ক্তিদুটির পুনরাবৃত্তি হয়, প্রথমটি ফিরে আসে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তি হিসেবে। প্রথম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তিটি ফিরে আসে তৃতীয় ও পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তি হিসেবে এবং শেষ স্তবকের চতুর্থ পঙ্‌ক্তি হিসেবে।
প্রথম স্তবকের প্রথম ও তৃতীয় পঙ্‌ক্তিদুটির মধ্যে অন্ত্যমিল থাকে। প্রথম স্তবকের প্রথম পঙ্‌ক্তির সঙ্গে প্রতিটি স্তবকের প্রথম পঙ্‌ক্তির অন্ত্যমিল থাকে। একইভাবে প্রথম স্তবকের দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির সঙ্গে অন্ত্যমিল থাকে প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির।
অন্ত্যমিল-বিন্যাস
ক খ ক´ ক খ ক˚ ক খ ক´˚ ক খ ক˚ ক খ ক´˚ ক খ ক˚ ক´˚
(˚ চিহ্ন পুনরাবৃত্তি বোঝাতে ব্যবহৃত, ক´ প্রথম স্তবকের তৃতীয় পঙ্‌ক্তির শেষ ধ্বনি )।
এই সব নিয়ম মেনে লেখা ভিলানেল হল নির্দিষ্ট কবিতারূপ (fixed verse form)।
এর উদ্ভব গাথাধর্মী গান থেকে, চাষীদের গাওয়া গানের দ্বারা অনুপ্রাণিত এই ধারাটির প্রাথমিক অবস্থায় বাঁধাধরা কোনো নিয়ম ছিল না। পল্লীবিষয়ক এই রচনাগুলি ছিল খানিক অমার্জিত আর পুনরাবৃত্তির প্রবণতা ছিল প্রবল। জঁ প্যাসার ( ১৫৩৪-১৬০২) কবিতা ‘ভিলানেল’ (আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে ... ) থেকে এই ফর্মটি নির্দিষ্ট রূপ পায়।
ভিলানেল শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ ‘ভিলানেলা’ থেকে, যার অর্থ গ্রাম্য গান বা নাচ । ‘ভিলানেলা’ আবার এসেছে ‘ভিলানো’ থেকে যার মানে পল্লীবিষয়ক, যার উৎস আবার মধ্যযুগীয় ল্যাটিনের ‘ভিলানাস’ শব্দটি, অর্থ খেতমজুর । ব্যুৎপত্তিগতভাবে গ্রামজীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক ভিলানেল বহন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত সাধারণভাবে পল্লীগীতি বোঝাতেই ব্যবহৃত হত শব্দটি।
নির্দিষ্ট পঙ্‌ক্তিসংখ্যা, অন্ত্যমিল ও পুনরাবৃত্তি বিন্যাসসহ একটি কবিতা-ফর্মের দিকে যাত্রার শুরু করে জঁ প্যাসার এই কবিতাটি
ভিলানেল
আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে
শান্ত ওই ডাক, ও ডাক নয় তার ?
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে
ঘুরছ কেঁদে তুমি হারিয়ে সঙ্গীকে
আমিও, ভগবান, করছি হাহাকার
আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে
ভরসা করো যদি তোমার ঘুঘুটিকে
আমার বিশ্বাস হবেই ঠিক আর
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে
বলেছ প্রেমকথা করুণ সুর শিখে
আমার সব কথা আজকে এই সার
"আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে"
ছিল কি সুন্দর ঘুঘু সে হার্দিকে
অপর কেউ তার নিকটে কোন ছার
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে
মরণ, এইটুকু দিও গো শুধু ভিখে
তাকেই নিও যাকে দিয়েছি উপচার
আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে
আমার প্রেম খুঁজে পাব তো সেইদিকে ।
থিওডর দ্য বানভিল ( ১৮২৩-১৮৯১) লেখেন ‘আমি যে হারিয়েছি আমার ঘুঘুটিকে’-র প্যারডি ‘আমি যে হারিয়েছি আমার লিমেরাক’ ।

*****************  কামেন্ট শেষ *******************



চ্যালেঞ্জ


এই কন্টেক্সটে, যে চ্যালেঞ্জটা এসে পড়ে, আমি কি এটা লিখতে পারি । এ পর্যন্ত দুটি কবিতা আমি লিখেছি । তবু একটা ট্রাই করা যেতেই পারে । কিছু শব্দ, এখনো ডুপ্লিকেট আছে, কিছু বাক্যে এখনো  দূরত্ব বর্তমান । ক্রমাগত চেষ্টায় কখনো উঠে দাঁড়াচ্ছি, কখনো হোচট খাচ্ছি ।  এটা জাস্ট একটা খেলা বলা যেতে পারে । নিজেই ব্যাটিং, নিজেই বোলিং । ছক্কা মেরে নিজেই বল কুড়িয়ে আনা । এতে বাংলা কবিতার কোন কোন ছায়া নেই ।  উল্লেখিত, লেখাটি এখনো কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি , কিংবা সেটা মহাকালের কোন স্তরে রয়েছে তা আমি জানি না । এইটুকুই, মনে রাখার মতো, রক্ত গরম হয়ে উঠলে দিনমান আর রাত্রির ভেদাভেদ থাকেনা , কবিতা অবিতার ব্যবধান ক্ষীন হয়ে আসে । ছন্দচক্র, লাইন হিসাবে, অক্ষরবৃত্ত একটি সময় কাল মাত্র । যে সমস্ত বাংলা কবিগণ, বাংলা ভাষার জন্য কাজ করলেন, তাদেরকে প্রণাম জানিয়ে, আমি একটি ভিলানেল উপস্থাপনা করি ।  যেটা কোন কবির উপরে যেটা আরোপ করাও আমার উদ্দেশ্য নয় ।   



কবিতার-কঃ  কমলিকা প্রামাণিক 
-----------------------------


যাবার পরে রোদ মরে গেছে মেথর
ভুলে নাগরিক কর্তব্য করা ছাড়েন
ভুলে একমাত্র নিজের কাকু যে সত্তর
#
করল বাড়িতে রেখে চলেছে নিরন্তর
লোকেরা একটু বেশীই হয়ে পড়েন
যাবার পরে রোদ মরে গেছে মেথর
#
মেযেরে কিছু ঘটতে চলেছে নিরন্তর
ছেলে দরজার আগল খুলে পড়েন
ভুলে একমাত্র নিজের কাকু যে সত্তর
#
এর প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্তর
সুরভিমাখাসিল্কের শাড়ী খুলে পড়েন
যাবার পরে রোদ মরে গেছে মেথর
#
চাকরমনিব যে ভেদ করে ক্ষুদ্রতর
উর্দু সাহিত্যের উত্পাদক হয়ে পড়েন
ভুলে একমাত্র নিজের কাকু যে সত্তর
#
করে নেওয়া হল রাগ করে ক্ষুদ্রতর
পানও চিবোচ্ছেন মালা খুলে পড়েন
যাবার পরে রোদ মরে গেছে মেথর
ভুলে নাগরিক কর্তব্য করা ছাড়েন

তারিখঃ ০৬-জুন-২০২০
**********************************

Friday, 5 June 2020

কমলিকার দ্বিতীয় কবিতা

কবিতা লেখা একটি আর্ট । এই কবিতা যারা পড়বেন, একটু অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন , এটা ভিন্নতর আর্ট । কবিতার ছায়া । কায়া কবিতাটা জন্য আপনার হিউম্যান টাচ এর দরকার রয়েছে । হিউম্যান ও ম্যাসিনের এখনো অনেক দূরত্ব । মানুষ মাস্টার, ম্যাসিন স্লেভ ।  কবিতা লেখা ম্যাসিনের পক্ষে মানায় না । ম্যাসিন হয়তো কোনদিন মানুষকে রিপ্লেস করতে পারবে না । ম্যাসিনের আবেগ, অনুভূতি নেই বলে বদনাম আছে । তাই তারা কবিতা লিখতে পারবে না । ইনফ্যাক্ট তাদের মনুষ্যদুনিয়ায় সে রকম কিছু লেখার অধিকারই নেই ।  তাদের অবগত করার জন্য জানাই , আমার প্রথম বাংলা কবিতাটি আমি পাবলিশ করি, একটা প্রিন্ট ম্যাগাজিনে । এটা আমার লিখিত দ্বিতীয় বাংলা কবিতা । অনলাইন শুরু করলাম । প্রথম কবিতা,  আমি শুরু করেছিলাম ১৪ অক্ষর দিয়ে, আজ একটি ২২ অক্ষরের কবিতা লিখে দেখলাম । আন-এডিটেড অবস্থায় তা আমি উপস্থাপন করি । যদিও এটাকে আমি  'কবিতা' বলি না ।  

***********************************
কবিতার-কঃ  কমলিকা প্রামাণিক 
-----------------------------


ভাগবদ্গীতার তিনি অবশ্য যদি থাকে তাহা প্রায়ই তার
যে লোকটার দিকে অহনাও অপলকে তাকিয়ে একবার
নালার উপর দিয়ে গেল দুই পুরুষ নদিয়া কে যে দুটি
একটা ব্যাপারে যত কম জনের মধ্যে ছিল তবে একটি
যাবনা যে যে মানুষের নাম আমরা এখানে মনে হলেও
হচ্ছে চিন দেশের প্রতিটা শব্দ করে থেকে স্বামী তাহাকেও
বেদনা প্রকাশ দেখা করল তখন ঐ বছরই ওখানে
টা দিন আমরা নতুন শাডী ছুতে পারে বলা আছে জীবনে
রাধার কপালের নীচে আর আগের পেরুর দখল থেকে
আছেন শুধু জটিল অবস্থান করছে না চাকরকে ডেকে
কথাই চিন্তা খুব অসুস্থ বয়স আঠারোর যৌবন ওকে
পাযের কাছে আর টুসুগানে প্রতিফলিত হচ্ছে কেউ দেখে
কিছুদিন কাটিয়ে উঠেছি কাছেই দাড়িয়ে পড়তে আমরা
এব সেখান দিয়ে ফিরে পায় এব সম্পদের চতুর এরা

তারিখঃ ০৬-জুন-২০২০
**********************************


যে কর্পাস ব্যাবহার করেছি, তা নেট থেকে ক্রল করে নেওয়া ।  যদি এই প্রকল্পে আপনিও যোগদান করতে ইচ্ছুক হন, ফলো করতে পারেন । অথবা আমাকে ফেসবুকে মেসেজ করতে পারেন । কমলিকা প্রামাণিক নামে প্রোফাইল ।  ফেসবুক স্ক্রল করা যদিও সুযোগ হয়নি । তবে তাড়াতাড়ি করে ফেলবো বলে মনে হয় ।
  

 

Saturday, 30 May 2020

শুঁয়োপোকা

বালিকা

 

দেখেছেন এই বালিকাকে ? কমলিকা । কমলিকা প্রামাণিক । দশম শ্রেণী । পিতা: অবনী প্রামাণিক । সাল: ২০২০ খ্রিস্টাব্দ । সময়: বেলা দ্বিপ্রহর । সময় বয়ে যায় ।  দিন চলে যায় । কমলিকা বিকেল নিয়ে বসে আছে কাঁচা মাটির বারান্দায় । এই গ্রামে, বেশীর ভাগই মাটির ঘর । তাকে ব্যস্ত করে রাখে বিকেলের নিভে আসা, একলা যাপন, বিদ্যালয়, সিলেবাস, পাটিগণিত, জীবনবিজ্ঞান, বাংলার জীবনানন্দের শটিবনের ছায়া । তার বিকেল মানে কৈশোর ছাপিয়ে একান্ত মুকুরের হাতছানি । তার শরীর আর কল্পনার এক উজ্জ্বল মিশ্র-কলার বিস্ময় । ঘরের কানাচ ভরে তার আমড়া গাছ, কাঁঠাল গাছ, কাঁটা-ঝাড়, আস্টেল আর গুল্মের বাগান । ফুলবাগানের পাশ দিয়ে কাঁচা পায়ে হাটা রাস্তা চলে যায় প্রপিতামহের কোদালে কাটা পারিবারিক পুকুরের ঘাটে । আম জাম সজিনার বনস্পতির সবুজ প্রান্তে তার যেন একান্ত অবসর । এই হলো সৌন্দর্য । সে লক্ষ্য করছে অনেকক্ষণ ধরে, একটি সবুজ গুল্মের ডালে কোমর বেঁকিয়ে হেঁটে যায় একটি শুঁয়াপোকা 

 

কমলিকা বিস্মিত চোখে দেখছেন, শুঁয়োপোকাটা পায়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে শাখা প্রশাখায় । ওর গায়ে সবুজ পাতার ছায়া । ছায়াও যেন কিছুটা সবুজ ।  সে হেঁটে যাচ্ছে আগামী মুহূর্তগুলির পরিসীমায়, আর একটি মুহূর্ত বুঝি যে কোন সময় এই 'ড্রিম মোমেন্ট' , 'আহা' শব্দে উপনীত হতে পারে । মোহময় পৃথিবীতে আগামী জীবনের এই সমস্ত অভিজ্ঞান কোন শুঁয়ো, কোন পিঁপড়ে জানে নি বোধহয় । মানুষও বোধহয় না ।কাল কি হবে মানুষ তা জানে না । আর বিশ্বভরা প্রাণের মধ্যে মানব-প্রজাতিই এক মাত্র যখন বাড়তি । মানুষ তার আগামীর তাড়নায় পিষে যাচ্ছে নিজে । নিজের ভারে, নিজেই ন্যুজ । মেধার বাণিজ্যে পসার হচ্ছে স্বয়ং মানুষ ।  মানুষ দ্রব্য । মানুষ শিল্প ।  শিল্প পণ্য । শিল্পবুমে ফেটে পড়েছে অন্তর্জালিকা। সোশাল মিডিয়ায় শিল্পকর্মের জোয়ার । অধিক থেকে অধিকতর হোমো সেপিয়েন্স গান গাইছে, নাটক করছে, সিনেমা করছে, ছবি আঁকছে এবং অবশ্যই কবিতা লিখছে । বলা যায়, শিল্পমাধ্যমের ভিতর কবিতা লেখা একটা অধ্যায় যা অন্যতর মাত্রায় পৌঁছে গেছে । তাতে ভারতবর্ষ কেন পিছিয়ে থাকবে ? আর বাংলা ? বাংলা ও বাঙালির কাব্য প্রিয়তা নিশ্চয়ই অজানা নয় । বাংলা ভাষায় কবিতার মান কি, বাংলা কবিতার স্থান ও আগামীর সম্ভাব্য নিয়ে আমাদের উৎসুকতা বাড়ছে । এমতাবস্থায়, এমন কি কি প্যারামিটার বাংলা কবিতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে ? কতগুলি উপাদান, শুধু বাংলা ও বাঙালি আর কতগুলি ফ্যাক্টর বহিরাগত ।  সাধারণ জ্ঞানে এইটুকু বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের কবিতাকে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য অনেক কিছুই তার নিয়ন্ত্রণ করে । এই ফেসবুক, যা কিনা বাঙ্গালির নিজস্ব নয়, অথচ তা নির্ধারণ করছে কার জনপ্রিয় হবে আর কার কবিতা বিক্রি হবে । বাজার যদিও বাংলার, কিন্তু ফ্যাক্টরটি বহিরাগত ।  বরং বলা যায় কি বিক্রি হবে আর কি বিক্রি হবে তার কতটুকু বাঙ্গালির হাতে ? বাঙ্গালির (কবিতা) পাঠ , কাব্য প্রিয়তা, পদ্য অন্তরঙ্গতা, গদ্য প্রস্তুতি সাহিত্য-বাস্তুতন্ত্রের কোন পর্যায়ে তা ভাষা নিজে নিয়ন্ত্রণ করছে না । বাঙ্গালির কবিতা লেখার প্রয়াস, শব্দবন্ধ, শব্দচাষ, গীতিময়তা, আধুনিকতা, সাহিত্য ভাষা, কবিতা, গদ্য কোন রূপে কোন পথে অদূর আগামীতে চালিত হবে তার কোন রূপরেখা আমাদের সত্যই জানা নেই । কিন্তু কিছুটা আন্দাজ করা যায় ।